ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অপরূপ বুদবুদি চড়া

হামীম রায়হান
🕐 ৩:০০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০৭, ২০১৯

যেদিন হঠাৎ বন্ধু সুজন ফোন করে বলল, চল দোস্ত, বুদবুদি ছড়া যাব। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলাম। খোলা কাগজের এগারজনের সদস্য মোরশেদ, শফিক, নাজিম, হোবাযুব, সারওয়ারসহ আরও কয়েক বন্ধুকে ফোন করে জানালাম বুদবুদি চড়া যাচ্ছি, তারাও রাজি। ঠিক হলো ২৩ অক্টোবর হবে যাত্রা।

বুদবুদি চড়া! এ আবার কেমন নাম? ভেঙে বললে তাকাতে হবে ৬৫ বছর আগে ১৯৫০ সালে। চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও গ্রামের পূর্বে পাহাড়ি এলাকায় প্রথম গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়া যায়। তৎকালীন সরকার গ্যাস উত্তোলনের দায়িত্ব দেয় একটি বিদেশি কোম্পানিকে। ১৯৫৩ সালে গ্যাস উত্তোলনের দ্বারপ্রান্তে এলে তারা গ্যাস ক্ষেত্রের গাভিতে সীসা ঢেলে দেয়, ফলে বন্ধ হয়ে যায় গ্যাস উত্তোলন এবং পাহাড়ের আশপাশের চড়াই সেই গ্যাস বুদবুদ করে উঠে। এ কারণে এই এলাকার নাম হয় বুদবুদি চড়া। যাক, সে সব কথা। ২৩ অক্টোবর সকাল ৮টায় রওনা হলাম আমরা দশ বন্ধু।

সঙ্গে নিলাম চাল, ডাল, মুরগিসহ রান্নার বিভিন্ন সরঞ্জাম। পটিয়া সদর থেকে তিন কিলোমিটারের পথ। পটিয়া ডাক বাংলা মোড় থেকে টেম্পু চড়ে যাত্রা শুরু হলো। ২০ মিনিটে পৌঁছালাম পাহাড়ের পাদদেশে। পিচঢালা রাস্তার পর কিছুটা ইটের পথ। তারপর পাহাড় শুরু। পথের দু’ধারে সবুজের বেষ্টনি। চোখজুড়ানো সৌন্দর্য। পাহাড়ের গায়ে জুম চাষ। হাঁটতে হাঁটতে কখনো মনে হচ্ছিল এটা বান্দরবান বা রাঙামাটির কোনো পাহাড়। সবচেয়ে মজার বিষয় এখানের রাস্তাগুলো পাহাড় কেটে বানানো কাঁচা রাস্তা, পাহাড়ে উঠতে একটু কষ্ট হলেও পাহাড় আরোহণের মজাটা পাচ্ছিলাম। ভ্রমণপ্রিয় পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারবেন তার অনুভূতি।

পাহাড়ের গায়ের সাধারণত বিভিন্ন ফলের বাগিচা, বিশেষ করে পেয়ারা, লেবু, সফেদা। বন্ধু সুজন বাগিচায় ঢুকে কিছু পেয়ারা নিল। চারদিক জনমানবহীন একটা অসাধারণ পরিবেশ। নাম অজানা হরেক রকম পাখির কলকাকলি মনকে মুগ্ধ করে দেয়। দুটো পাহাড় পেরোতেই দেখলাম একটা ছোট টং (চায়ের দোকান)। সবাই বসে চা খেলাম। সেখানে কাঠ কাঠতে আসা মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে প্রায় বন্যহাতি আসে এবং তারা দেখাল হাতি যাওয়ার পথ। নিষেধ করল ওই পথ দিয়ে যাওয়ার।

ঘড়িতে সময় ১০টা। আবার যাত্রা শুরু হলো। বন্ধু নাজিম গলা ছেড়ে গান ধরল ‘ও আমার উড়াল পঙ্কি রে, যা যা তুই উড়াল দিয়ে যা .....’ আমাদের আর বাঁধে কে? শুরু হলো গলা ফাটানো গান। কিছুদূর এগোতেই সামনে পড়ল ছোট পাহাড়ি লেক। লেকের স্বচ্ছ পানিতে মাছদের ছোটাছুটি, চিকচিক করা বালি। মোরশেদ ব্যর্থ চেষ্টা করল মাছ ধরার। লেকের একপাশে পাহাড় অন্য পাশে শরতের কাশফুল। মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতা।

‘চিকচিক করে বালি কোথা নেই কাদা
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা’

হঠাৎ সবাই বেশ সচকিত হয়ে গেলাম অদ্ভুত শব্দ শুনে। দেখলাম পাহাড়ের বেশ উঁচুতে অনেক বানর। ছোট বড় প্রায় হাজার খানেক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখলাম এ দৃশ্য। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে ওই পাহাড় কালা ফকিরের মাজার। আর ওই মাজারের, বানরগুলো আসে।

কিছুদূর গিয়ে কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলো। জানতে পারলাম তারা পটিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র। আরও কিছুদূর গিয়ে দেখা হলো কিছু বয়স্ক লোকের সঙ্গে। যারা রেলওয়ে শ্রমিক। অবসরে বেড়াতে এসেছে। বুঝতে পারলাম এখানে প্রায় এমন পর্যটক আসেন।

লেক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একটা পাহাড়ি ঝর্ণা। পরিষ্কার শীতল পানি নেমে আসছে পাহাড়ের বুঝ ছিঁড়ে। সেই ঝর্ণার আশপাশে দেখলাম পানি বুদবুদ করছে। বুঝতে পারলাম, এই পাহাড়ের উপরেই গ্যাস ক্ষেত্রটি। বন্ধু সারওয়ার বাঁশের ছোট কঞ্চি নিয়ে সেই বুদবুদের ওপর এমনভাবে বসাল যাতে বুদবুদটা বাঁশের ভেতরেই উঠে। আর বাঁশের মাথার আগুন ধরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের মাথায় আগুন জ্বলতে লাগল। অদ্ভুত দৃশ্য।

পাহাড়টা বেয়ে উপরে উঠলাম। তিনটা মুখপোড়া হনুমান আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে বিরক্ত হয়ে পালিয়ে গেল। পাহাড়ে দেখলাম গ্যাস উত্তোলনের জন্য করা বড় বড় সেই দেয়ালগুলো। বন্ধু মাইন একটা জায়গা নির্দেশ করে বলল এটাই হলো সেই জায়গা সেখানে সীসা ঢালা হয়েছিল। খানিকটা গিয়ে দেখলাম দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।

সেই আগুন কখনোই নিভে না, সারা বছর এভাবেই জ্বলছে। কয়েকজন লোক দেখলাম সে আগুনে রান্না করছে। তারা কাঠুরে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। আমাদের বন্ধু হোবায়ুব রান্না শুরু করল। কাঠুরেদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম রাতের বেলা শীতের সময় অনেক বন্য প্রাণী এই আগুনে উষ্ণ হতে আসে। বাঘ ভালুকের মতো প্রাণীরাও। রান্না হলো খিচুড়ি ও মুরগির বুনা। এ যেন এক অন্য জগৎ। চারদিকে সমারোহ, কাশফুল, ঝর্ণার শব্দ, গ্যাসের বুদবুদ। অর্ধপেট আহার তারপরও যে অমৃত।

ঘড়িতে সময় ৩.০০টা। এবার ফেরার পালা। ফিরতে ফিরতে মনে হলো আরে এমন সুন্দর একটা জায়গা সবার অগোচরে থেকে গেল! এখানে পাহাড়গুলো উঁচু নয়, কিন্তু এখানের এই আনন্দ অন্য কোনো পর্যটন কেন্দ্র থেকে কোনো অংশে কম নয়। প্রশাসনের সুদৃষ্টি পড়লে এটা হয়তো হতে পারে একটি অন্যতম পর্যটক কেন্দ্র। বিকেলে বাড়ি ফিরলাম একটা প্রফুল্ল মন ও কিছু অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে।

সাধারণ সম্পাদক, এগারজন
পটিয়া, চট্টগ্রাম।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper