ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শুদ্ধি অভিযান

ফসল খুঁজছে আ.লীগ

শফিক হাসান
🕐 ১০:১৮ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০৬, ২০১৯

ঘর থেকেই শুদ্ধি অভিযান পরিচালনায় শীর্ষ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে প্রশংসিত হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। শুদ্ধি অভিযানে দলে দুর্নীতিগ্রস্ত অংশে আতঙ্ক ছড়ালেও একাংশ এতে যারপরনাই খুশি। দলের শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা প্রত্যাশাকারীরা এটাকে ইতিবাচক সংকেত হিসেবে দেখছেন। মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিবুদ্ধির চেতনা লালনকারীরা এটাকে আখ্যায়িত করছেন সবুজ সংকেত হিসেবে।

১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এ অভিযানের প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হয়েছে। কৌশলগত কারণে বর্তমানে একটু ঢিলেডালাভাবে চললেও আগামীতে পূর্ণগতিতে ফিরবে শুদ্ধি অভিযান এমনটাই ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে আওয়ামী লীগ বহুল আলোচিত শুদ্ধি অভিযানের ফসল খুঁজছে। কী মিলল এ অভিযানে, বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এটাকে কোনদিকে প্রবাহিত করা উচিত- চুলচেরা বিশ্লেষণ ও হিসাব-নিকাশ চলছে দলে। সাধারণ মানুষও রাখছে তীক্ষ্ণ নজর। অন্যদিকে বিএনপি এ অভিযানকেও প্রশ্নবিদ্ধ আখ্যা দিয়ে সরকারের সমালোচনা করছে।

চলমান অভিযানের ভালোমন্দ যাই হোক, এতে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূল পর্যায়েও বার্তা পৌঁছেছে- দুর্নীতি কিংবা অসাধু তৎপরতার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একার সিদ্ধান্তেই পরিচালনা করছেন এই অভিযান। তাই কেউই জানেন না, কে হবেন পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু!

চলতি বছরে, আগামী দেড় মাসের মধ্যেই শেষ হবে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর কাউন্সিল। গতকাল বুধবার সম্পন্ন হয়েছে কৃষক লীগের কাউন্সিল। এতে বড় কোনো চমক না থাকলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুষ্ঠিতব্য সহযোগী সংগঠনের কাউন্সিলে নতুন ও ত্যাগী নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। শুদ্ধি অভিযানে বিতর্কিতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দুঃসময়ের পরীক্ষিত নেতাদের দেওয়া হবে সংগঠনের পদ। এতে তাদের মূল্যায়নের পাশাপাশি শুদ্ধি অভিযানের যথার্থতাও প্রতিষ্ঠিত হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুদ্ধি অভিযানের বড় প্রভাব পড়বে আর্থিক খাতে। অবৈধ ক্যাসিনোর প্রসারের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে পুঁজিবাজার। ব্যাংক খাতে সৃষ্টি হয়েছে তারল্য সংকট। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে শেয়ারবাজার। এক ক্যাসিনো দানবই দেশে নানাভাবে সৃষ্টি করেছে অস্থিতিশীলতা। বস্তুত অর্থনীতিকে মন্দাবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই গত ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মাধ্যমেই শুরু হয় আওয়ামী লীগের ‘শুদ্ধি অভিযান’। ধারণা করা হচ্ছে এ অভিযানে রাঘব-বোয়ালরা ধরা পড়লেও এখনো বড় কোনো গডফাদারের মুখোশ উন্মোচিত হয়নি। ওস্তাদের মার শেষ রাতে প্রবাদ অনুসরণ করে গডফাদারদের দৌড়ের ওপর রেখে গ্রেফতার করা হবে। তার আগ পর্যন্ত চলবে অর্থ খাতে অচলাবস্থা সৃষ্টির আরও কারণের মধ্যে রয়েছে সুইস ব্যাংকসহ বিদেশের অন্যান্য ব্যাংকে টাকা পাচার; মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোমের সংখ্যা বৃদ্ধি। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত অনেকেই বিদেশের ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখার পাশাপাশি বাড়ি কিনেছেন। যাতে সুসময়ে কিংবা দুঃসময়ে দেশ ছেড়ে সহজে চম্পট দেওয়া যায়।

চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৮’র বার্ষিক প্রতিবেদন বলা হয়- ২০১৮ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৯ শতাংশ বা এক হাজার ২০০ কোটি টাকা বেড়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা পাঁচ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা।
শুধু ব্যাংকে গচ্ছিত কালো কিংবা বৈধ টাকাই নয়, বিদেশে সেকেন্ড হোমের কারণেও অর্থ পাচার হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে সেকেন্ড হোম নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেকেই তুলনামূলক সহজ বলে বেছে নিয়েছেন মালয়েশিয়াকে। ইতিমধ্যে ব্যবসায়ী, সরকারের বিভিন্ন স্তরের আমলা, রাজনীতিবিদসহ নানা পেশার চার হাজারের বেশি নাগরিক সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন দেশটিতে। যদিও সেকেন্ড হোমের বাসিন্দারা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। এভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা পদ্ধতিতে টাকা পাচারের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে অশনি সংকেত।

ক্যাসিনো ও টেন্ডারবাজির টাকা সহজেই পাচার হয়ে যাচ্ছিল বিদেশে। শেয়ারবাজারে ধস নামার বড় কারণও অবৈধ ক্যাসিনোতে জুয়াখেলা। ক্যাসিনো তুলনামূলক বেশি লাভজনক, সহজেই মুনাফার মুখে দেখা যায়। ফলে অনেকেই রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার বাসনায় ঝুঁকেছেন ক্যাসিনোকাণ্ডে। অভিযান পরিচালনাকালে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে আবিষ্কার করেছেন টাকার পাহাড়! যুবলীগের জি কে শামীম থেকে শুরু করে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, হাবিবুর রহমান পাগলা মিজানসহ ছোটখাটো নেতাদের কাছেও মিলেছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার। দৃশ্যের বাইরেও রয়ে গেছে আরও অনেক বেশি টাকা ও সম্পদ। ফলে দুর্বৃত্তরা ফুলে-ফেঁপে উঠলেও হুমকিতেও পড়েছে দেশের অর্থনীতি। সাধারণ মানুষের সংকট বেড়েছে আরও।

ইতোমধ্যে ক্যাসিনোর মতো পুঁজিবাজারেও শুদ্ধি অভিযান দাবি করেছেন বিনিয়োগকারীরা। ইতিপূর্বে ২১ দফা দাবি তুলে ধরে পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতন ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ। চলমান শুদ্ধি অভিযান এবং অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও এতে কতটুকু সুফল মিলবে, ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান সংকট কতটুকু কাটবে- বোঝা যাবে নির্দিষ্ট সময়ের পরে। এ খাতে সাফল্য পেলে সরকার পর্যায়ক্রমে অন্যান্য দিকেও শুদ্ধি অভিযান চালাবে।

বরাবরই উন্নয়নের সুফল খেয়ে ফেলে দুর্নীতি। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদ থেকে বর্তমান পর্যন্ত দেশে নানাবিধ উন্নয়নমূলক কাজের সূচনা করেছে। এখনো চালু রয়েছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ কয়েকটি মেগা প্রকল্প। কিন্তু এসব মেগা প্রকল্পে হচ্ছে মেগা দুর্নীতি। রূপপুরের বালিশকাণ্ড কিংবা ফরিদপুরের পর্দা কেলেঙ্কারি- সর্বত্রই দুর্নীতিবাজরা সক্রিয়। দুর্নীতির নেপথ্যের কয়েকজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করলেও বড় একটি অংশ রয়ে গেছে মুক্ত বাতাসে। এদের কেউ কেউ চেষ্টা করছেন বিদেশে পালিয়ে যেতে। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননসহ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর মতো হাই প্রোফাইল নেতারাও।

পর্যায়ক্রমে আরও নতুন নাম বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সেটা নির্ভর করছে শুদ্ধি অভিযানের ভবিষ্যতের ওপর। শুদ্ধি অভিযানের প্রতিফলন ঘটবে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর কাউন্সিলে। দীর্ঘদিন পর কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ায় নতুন উদ্দীপনায় মেতেছে দল। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত সর্বত্রই বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ। ধারণা করা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কারের পর যেভাবে যাচাই-বাছাই করে কমিটি করার সিদ্ধান্ত হচ্ছে তাতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে পারে।

এজন্য অপেক্ষা করতে হবে কাউন্সিল শেষে নতুন কমিটির কার্যক্রম পর্যন্ত। বর্তমানে সাধারণ মানুষ শুদ্ধি অভিযানের সুফল না পেলেও ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে সেটা ‘ক্যাশ’ করতে পারবেন দেশের মানুষ। সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজরা নিপাত গেলে সাধারণ মানুষ পাবেন ভোগান্তিমুক্ত দিনযাপনের সুযোগ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও অপেক্ষা করছে ফলাফল দেখার ও সুফল বোঝার জন্য। শুদ্ধি অভিযানের পূর্বাপর বিশ্লেষণেই নেওয়া হবে কাক্সিক্ষত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

 
Electronic Paper