শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে পেটাল ছাত্রলীগ
জাবি অনির্দিষ্টকাল বন্ধ
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:০২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০৫, ২০১৯
দুর্নীতির অভিযোগে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে বিকাল ৪টার (গতকাল ৫ নভেম্বর) মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে হল ছাড়ার এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা।
হামলার ঘটনার পর জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেছেন, ছাত্রলীগ দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করেছে, আমি কৃতজ্ঞ। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জাবির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আছে, তিনি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন।
জানা গেছে, গত ২৪ অক্টোবর থেকে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনকারীরা টানা ১০ দিনের মতো নতুন ও পুরনো দুটি প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করে রাখে। ফলে এই ১০ দিন ভিসি, দুই প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রারসহ কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীই প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশ করতে পারেননি। কার্যত অচল হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে ভিসিকে তার বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। যতদিন না উপাচার্যকে অপসারণ করা হবেন, ততদিন অবরোধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন তারা।
মঙ্গলবার বেলা ১১টায় আন্দোলনকারীরা যখন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন, তখন উপাচার্যপন্থি শিক্ষকরা সেখানে যান। তারা আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তুলে দিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে ঢোকার চেষ্টা করেন। তবে আন্দোলনকারীদের বাধার মুখে তারা উপাচার্যের বাসভবনে ঢুকতে পারেননি। এর কিছুক্ষণ পর দুপুর ১২টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ব্যানারবাহী একটি মিছিল সেখানে আসে।
এতে দুই শতাধিক নেতাকর্মী ছিলেন। জাবি শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি জুয়েল রানা মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মিছিল থেকে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় ৮ শিক্ষক, ৪ সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের বিশ্ববিদ্যাল মেডিকেল সেন্টার ও এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আহতদের মধ্যে শিক্ষকরা হলেন অধ্যাপক সাইদ ফেরদৌস, মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্যাপক রায়হান রাইন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার হাসান মাহমুদ, অধ্যাপক শামীমা সুলতানাসহ আরও কয়েকজন।
আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে দর্শন বিভাগের মারুফ মোজাম্মেল, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাহাথির মুহাম্মদ, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাইমুম ইসলাম, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের রাকিবুর রনি, ইংরেজি বিভাগের আলিফ মাহমুদ, অর্থনীতি বিভাগের উল্লাস, দর্শন বিভাগের রুদ্রনীল, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সৌমিক বাগচীসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
এছাড়া ৪৪তম আবর্তনের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্রী ছন্দা ও ৪৭ ব্যাচের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাউদা নামের দুই নারী শিক্ষার্থীও মারধরে আহত হন। হামলায় আহত সাংবাদিকরা হলেন-প্রথম আলোর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মাইদুল ইসলাম, বার্তা টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আজাদ, বার্তাবাজারের প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমু, বাংলা লাইভ টোয়েন্টিফোরের প্রতিনিধি আরিফুজ্জামান উজ্জল। হামলার ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জরুরি সিন্ডিকেট সভায় ডাকে।
এতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ও সিন্ডিকেটের সদস্য সচিব রহিমা কানিজ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তবে হল ছাড়ার যে নির্দেশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় প্রত্যাখ্যান করেছে আন্দোলনকারীরা। একই সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এবং বিকাল পৌনে ৪টার দিকে তারা আবার আন্দোলন শুরু করে। হল ছাড়ার ঘোষণার প্রতিবাদে ছাত্রীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ-মিছিলও করেন।
আন্দোলনের সমন্বয়ক অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেছেন, হামলার ঘটনায় আন্দোলনকারী শিক্ষক, ছাত্রী এবং দায়িত্বরত কয়েকজন সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ৩০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থীসহ ৭-৮ জন বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রলীগ সশস্ত্র হয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়। পিস্তল নিয়ে আসে তারা। তারা আমাদের মাড়িয়ে যেতে চায়। আমাদের কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত। তারা আমাদের শিক্ষক এবং নারী শিক্ষার্থীদেরও পিটিয়েছে, লাথি দিয়েছে, চেয়ার দিয়ে পিটিয়েছে। প্রশাসনের নির্দেশনায় এ হামলা হয়েছে। এই উপাচার্যের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। এ সময় হল ছাড়তে প্রশাসনের দেওয়া নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের দেড় হাজার কোটি টাকা থেকে ঈদের আগে কোটি টাকা ছাত্রলীগ নেতাদের দিয়ে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তা তদন্তের দাবিতে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলনরত শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। চাপের মুখে উপাচার্য ফারজানা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেও তা ফলপ্রসূ না হওয়ায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর তার পদত্যাগের দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন, গত সপ্তাহ থেকে আন্দোলনকারীরা শুরু করে ধর্মঘট।
হামলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, আমরা শিবিরমুক্ত ক্যাম্পাস চাই। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল।
অন্যদিকে আন্দোলকারীদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, আন্দোলনে কোনো শিবির সংশ্লিষ্টতা নেই। যে কোনো শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য শিবির ব্লেইম দেওয়াটা পুরনো অপকৌশল। বুয়েটের আবরারকে এভাবেই হত্যা করা হয়েছে, এখানেও একইভাবে অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ঘটনাস্থলে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। চেষ্টা করেও আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। বড় ঘটনা এড়াতে আমরা তৎপর আছি।