ছাত্ররাজনীতির অতীত বর্তমান
আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ৯:১৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২২, ২০১৯
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যার ঘটনায় বুয়েটসহ গোটা দেশেই এক দফা ছাত্র আন্দোলন হয়ে গেল। সরকারবিরোধী মন্তব্য করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় বুয়েটের এই ছাত্রকে শের-ই-বাংলা হলের টর্চার রুমে ডেকে নিয়ে দফায় দফায় শারীরিকভাবে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের শিকার হয়ে এক সময় তার মৃত্যু হয়। তখন আবরারের নিথর দেহ চাদরে মুড়িয়ে সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয়।
কি নির্মমতা! শুধু ফেসবুকে সরকারবিরোধী মন্তব্য করায় বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরারকে। স্বভাবতই বুয়েটসহ গোটা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল, কলেজ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধে। সর্বত্রই এক আওয়াজ, দোষী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ইতোমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসায় বেরিয়ে আসা জড়িতদের একে একে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভারত সফর ও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অভিজ্ঞতা নিয়ে গণভবনে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, বুয়েট ছাত্র আবরারের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের কোনো দলীয় পরিচয়ে ছাড় দেওয়া হবে না।
যারা ফৌজদারি অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিতের অঙ্গীকারও করেন তিনি। এমনকি শুধু বুয়েট নয়, গোটা দেশে ছাত্রদের হলসমূহে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করারও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
উল্লেখ্য, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিটি নাগরিক সমানভাবে ভোগ করেন, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু মত প্রকাশের সুযোগ-সুবিধা কাগজ-কলমে থাকলেও বাস্তবে তার যদি প্রতিফলন না থাকে, তাহলে সে রাষ্ট্র কাঠামোকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। বরং স্বৈরতান্ত্রিক বলাই শ্রেয়। আবরার হত্যাকাণ্ড ঘটার পর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে একে একে বেরিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন সরকারের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের নানাভাবে ছাত্র নির্যাতনের করুণ কাহিনী। অর্থাৎ কেউ দ্বিমত পোষণ করলেই তাদেরই ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হতে হতো। বলতে গেলে বুয়েটে ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম তেমন একটা ছিল না। এ অবস্থা শুধু বুয়েটে কেন, গোটা দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির হালহকিকত অনেকটাই এ রকমের।
আমরা পাঠ্যবইয়ে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের কথা কম বেশি সবাই পড়েছি। স্মরণে আছে, নিউটনের তৃতীয় সূত্র হচ্ছে, প্রতিটি বস্তুর ক্রিয়ার সমপরিমাণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যার অর্থ, যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে স্বাধীনভাবে কথা বলার আকাঙ্ক্ষা সমানভাবেই যে বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। একবার সুযোগ পেলে সবাই কথা বলার অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবেন, এটাই বাস্তবতা। হয়েছেও তাই। বুয়েট ছাত্রলীগ স্বাধীনভাবে কাউকে কথা বলতে না দেওয়ায় আবরারের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমস্বরে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা পথে নেমে এসেছেন।
যারা কোনো দিন বক্তৃতা করেননি বা মিটিং মিছিল করেননি তারাও এখন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বক্তৃতা দিচ্ছেন, মিছিল করছেন। অর্থাৎ, প্রয়োজন মানুষকে যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশেও নিজেদের সক্ষম করে তোলে। বুয়েটসহ গোটা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন চলছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন। এমনকি যে রাজনীতি মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, সে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করাই শ্রেয়! এই মর্মে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে বুয়েট এখন উত্তাল।
অথচ বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল অনন্য। পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা স্তিমিত হলে ব্রিটিশবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতাসহ অনেকের জীবনের আত্মাহুতির মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়েছে আমাদের মহান স্বাধীনতা। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত নামক রাষ্ট্রের জন্ম। আমরা পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালিদের ওপর নেমে আসে নব্য পশ্চিমা পাকিস্তানি শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতন। যার বিরুদ্ধে এ দেশের ছাত্র সমাজের আন্দোলন সংগ্রাম ছিল মুক্তির একমাত্র পাথেয়।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই আঘাত হানে বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার ওপর। এতে দেশের ছাত্র সমাজ মাতৃভাষার দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আন্দোলন প্রতিহত করতে ১৪৪ ধারা জারি করে। সংগ্রামী ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে রাজপথে নামলে রফিক, বরকত, সালাম, জব্বারের বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শোষণ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে ’৬৯ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন সর্বোপরি ’৭১-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বের শীর্ষে ছিল এ দেশের ছাত্র সমাজ। তৎকালীন ডাকসুর সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে।
স্বপ্ন ছিল দেশ স্বাধীন হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো। বন্ধ হবে শোষণ বঞ্চনা। কিন্তু বাস্তবে দেশ স্বাধীন হলেও দেশে শোষণ বঞ্চনা বন্ধ হয়নি। বরং নব্য ধনিক গোষ্ঠীর শোষণ বঞ্চনা, লুটপাটে জনজীবন আজ বিপন্ন। উল্টো পাকিস্তান আমলের কোটিপতি বাইশ পরিবারের বদলে দেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা প্রায় ৫৬ হাজার। কৃষিনির্ভর দেশের কৃষকের অবস্থা এখন শোচনীয় পর্যায়ে।
দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। ‘লাঙ্গল যার জমি তার’-এ আদলে দেশ স্বাধীন হলেও নব্য ধনিক গোষ্ঠীই হয়েছে জমির মালিক। আর জমি হারিয়ে এ দেশের কৃষক হয়েছে ভূমিহীন কিংবা বর্গাচাষী। যাদের দিন চলে অতি কষ্টে। উল্লেখ্য, সাত কোটি জনসংখ্যার দেশে আজ জনসংখ্যা ১৬ কোটির ঘর অতিক্রম করেছে। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের বড়ই অভাব। কোটি কোটি শিক্ষিত, আধা শিক্ষিত যুব সমাজের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা এখন সুদূরপরাহত।
এমনকি শিক্ষার উপকরণ, শিক্ষার খরচ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিত্তশালীদের অনেকেই এখন শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এমনভাবে সুদৃঢ় করেছেন, যেখানে সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ এখন সোনার হরিণ। আবার শিক্ষা শেষে চাকরির অভাব, বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে যুব সম্প্রদায় বিপদগামী হচ্ছে। ফলে দেশে এখন মাদকের রোষানলে পড়ে সম্ভাবনাময় অনেকের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। এখন সামাজিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে।
এমন এক সময় ছিল, যখন আদর্শের ওপর ভর করে দেশে রাজনীতির চর্চা হতো। যখন রাজনীতি ছিল ত্যাগের কিন্তু এখন রাজনীতিতে ত্যাগের বদলে ভোগের আগ্রাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর ছাত্ররাজনীতির অবস্থাও তথৈবচ। ফলে ক্ষমতাসীনদের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আদর্শের বদলে ভোগ বিলাসের চর্চাই বেশি হচ্ছে।
যার জ্বলন্ত উদাহরণ, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব থেকে তাদের সরিয়ে দিয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং ভোগ বিলাসের জীবন কাহিনী দলীয় নেতানেত্রীদের হতবাক করেছে। সেই ছাত্রলীগ বুয়েট শাখার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের রোষানলে পড়ে অকালে জীবন প্রদীপ নিভে গেল আবরার ফাহাদের। কত স্বপ্ন ছিল বাবা-মায়ের। ছেলে প্রকৌশলী হবে। মুখ উজ্জ্বল করবে বাবা-মায়ের। আর এক সময় হাল ধরবে বাব- মায়ের সংসারের। কিন্তু আদর্শভ্রষ্ট ছাত্ররাজনীতির আগ্রাসন আবরারের পরিবারকে দিশাহারা করে দিয়েছে।
পরিশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য ছাত্র সংগঠনগুলোকে আদর্শের চর্চা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা সমাধানে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ জন্য ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়, বরং ছাত্ররাজনীতিকে জনকল্যাণে সম্পৃক্ত করতে হবে। আর ছাত্ররাজনীতিকে কুলষমুক্ত করতে না পারলে ক্ষমতাসীনদের ভবিষ্যতে আরও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি যে হতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আব্দুল হাই রঞ্জু : ব্যবসায়ী ও কলাম লেখক
[email protected]