ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এ কী বলেন মেনন

শফিক হাসান
🕐 ১১:১১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২০, ২০১৯

বরিশালের দলীয় একটি জনসভায় গত শনিবার ‘সাক্ষ্য দিয়েছেন’ রাশেদ খান মেনন, এই সাক্ষ্যের পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা চলছে দেশ-বিদেশে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এই নেতা আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচন হয়েছেন, মন্ত্রী ছিলেন দুবার। ১৪ দলের অন্যতম নেতা রাশেদ খান মেনন সরকারে থেকেও কীভাবে ‘সরকারবিরোধী’ অবস্থান নেন এমন প্রশ্ন করছেন সংশ্লিষ্টরা। মেননের এমন বক্তব্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে বিব্রতকর অবস্থা বিরাজ করলেও বিরোধী শিবিরে চলছে ‘খুশির মাতম’।

তারা যে ধরনের কথা বলে সরকারের সমালোচনা করেন, ঠিক অভিন্ন ভাষায় সরকারের সমালোচনা করায় মেননকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। অন্যদিকে গতকাল রোববার মেনন বিবৃতি দিয়ে দাবি করেছেন, তার বক্তব্য প্রচারমাধ্যমে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

পক্ষ-বিপক্ষের তর্ক-বিতর্কের প্রভাব পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও। নেটিজেনদের বড় একটি অংশ লিখেছেন- ক্যাসিনোর টাকায় ফ্রুটিকা পান করে সত্য উগরে দিচ্ছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি। গত ১৮ সেপ্টেম্বর শুদ্ধি অভিযানে গ্রেফতার হন যুবলীগ নেতা ও ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।

পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ এবং যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট জানিয়েছেন, তারা প্রতি মাসে মেননকে কয়েক লাখ টাকা দেন। যদিও মেনন শুরু থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। একদিকে ক্যাসিনো সম্পৃক্ততা অন্যদিকে ওয়ার্কার্স পার্টিতে আসন্ন ভাঙন ঠেকাতেই তিনি এমন বক্তব্য দিতে পারেন বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, শ্যাম রাখি না কুল রাখির মতো অবস্থায় এমন বক্তব্য দিতে পারেন মেনন। ক্যাসিনোকাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে তাকে এমন আভাসও মিলেছে। যুবলীগ নেতাদের স্বীকারোক্তি ও ক্লাবে আলামত মেলায় ফেঁসে যেতে পারেন মেনন- আগ থেকেই তা আঁচ করতে পেরে ‘অসংলগ্ন’ বক্তব্য দিচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

১৪ দলের অন্যতম এই শরিক গত শনিবার দুপুরে বরিশালের অশি^নী কুমার হলে জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সম্মেলন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বিগত নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত (সংসদ সদস্য) হয়েছি। তারপরও আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জাতীয়, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ।’

প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে এই বাম ঘরানার নেতা আরও বলেন, ‘আপনি-আমি মিলে যে ভোটের জন্য লড়াই করেছি, আজিজ কমিশনকে ঘেরাও করেছি, আমরা এক কোটি ১০ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকা ছিঁড়ে ফেলে নির্বাচন বর্জন করেছি মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরও। আজকে কেন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং জাতীয় নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে আসবে না?’

এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় গতকাল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ে বলেন, ‘মন্ত্রী হলে কি রাশেদ খান মেনন এ কথা বলতেন? তিনি যদি বলেই থাকেন, এত দিন পরে কেন? এই সময়ে কেন? নির্বাচন অনেক আগে হয়ে গেছে।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতির এমন বক্তব্য দেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তার কাছ থেকে সবসময় দায়িত্ববোধ থেকে বক্তব্য আশা করি। ১৪ দলের মিটিং ডেকে এর জবাব চাওয়া হবে।’

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘নিশিরাতের সরকারের সঙ্গী রাশেদ খান মেনন যে কোনো কারণেই হোক, এবার নিজের মুখে মহাসত্যটি স্বীকার করেছেন। বিবেকের তাড়নায় মেনন সত্য কথাগুলো বলতে শুরু করেছেন, হয়তো কয়েক দিন পর ওবায়দুল কাদের এবং হাছান মাহমুদরাও বলবেন।’

গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমন্বয়ক ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘দেরিতে হলেও উনি বলেছেন। আমি বারবার বলে যাচ্ছি, কেউ ভোট দিয়েছেন কি-না। এ পর্যন্ত একজনও পাইনি যে ভোট দিয়েছেন। তাই আমি ওনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, উনি ওভারকাম করলেন।’

এদিকে গতকাল ওয়ার্কার্স পার্টির কামরুল আহসান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে রাশেদ খান মেনন গণমাধ্যমে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছে দাবি করে বলেন, ‘বরিশাল জেলা পার্টির সম্মেলনে আমার একটি বক্তব্য সম্পর্কে জাতীয় রাজনীতি ও ১৪ দলের রাজনীতিতে একটা ভুল বার্তা গেছে। আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ উপস্থাপন না করে অংশবিশেষ উত্থাপন করায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। স্পষ্ট করে বলতে চাই, এ যাবতকালের নির্বাচন ১৪ দলের সংগ্রামেরই ফসল এবং সরকারও গঠিত হয়েছে ১৪ দলের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। আজকে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার যে বিপদ বিদ্যমান তাকে মোকাবেলা করতে ১৪ দলের সংগ্রামকেই এগিয়ে নিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, আমি কেবল এখনই নয়, জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে পার্লামেন্টে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলাম, একাদশ সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অভিজ্ঞতাটি সুখকর নয়। বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে এলেও নির্বাচনকে ভুল করা, নিদেনপক্ষে জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার কৌশল প্রয়োগ করেছে নির্বাচনে। ...এটা যেমন সত্য, তেমনি এ ধরনের পরিস্থিতিতে অতি উৎসাহী প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বাড়াবাড়ি করতে পারে। তাতে নির্বাচন অশুদ্ধ বা অবৈধ হয়ে যায় না।’

শনিবারে বক্তব্য দিয়ে ‘শনির দশা’য় পড়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাবেক এই মন্ত্রী; গতকাল রোববার উল্টো গণমাধ্যমকে দোষারোপ করে তিনি যে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছন তাতে তার ভাগ্যাকাশে ‘রবি’ উদিত হবে কি-না সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েক নেতা বক্তব্য রাখলেও এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী মুখ খোলেননি এখনও। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মেননের এমন অবস্থানে সাদৃশ্য পেয়েছেন রামায়ণের গল্পের। তারা বলছেন, এ কী শুনি মন্থরার মুখে!

রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের নেপথ্যে যা-ই থাক, এটা সত্য বর্তমানে তিনি একধরনের চাপের মধ্যে রয়েছেন। ইতিপূর্বে কয়েকবার ভেঙেছে তার নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টি। বর্তমানে সরকারের সঙ্গে তার শতভাগ ‘তাল মিলিয়ে’ চলা পছন্দ করছেন না দলের শীর্ষ নেতা। বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খান বিউটিকে মনোনয়ন দেওয়া দলের বড় একটি অংশ মেনে নিতে পারেনি। বর্তমানে স্বামী-স্ত্রী দুজনই সরকারের সংসদ সদস্য, অন্যদিকে ত্যাগী নেতাকর্মীদের যথোচিত মূল্যায়ন করা হচ্ছে না বলে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যে কোনো সময় ওয়ার্কার্স পার্টিতে শোনা যেতে পারে ভাঙনের শব্দ।

এদিকে ক্যাসিনো-সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘কারা এটা বলেছে। তারা যদি বলে থাকে, প্রমাণ করুক। তারা কি জবানবন্দি দিয়েছে? আদালতে স্বীকার করেছে? পুলিশ কমিশনার ক্যাসিনোর কথা জানতেন না আর আমি কীভাবে জানব?’
ইয়ংমেন্স ক্লাবে র‌্যাবের অভিযানের সময় একটি কক্ষে দেখা গেছে রাশেদ খান মেননের ছবি ঝোলানো। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, তিনি একটি ক্রেস্ট প্রদান বা গ্রহণ করছেন।

ফকিরাপুলে ক্যাসিনো চালানো ইয়ংমেন্স ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেনন। রিমান্ডে খালেদ জানিয়েছেন, ক্যাসিনো কারবার থেকে প্রতি মাসে মেনন চার লাখ টাকা নিতেন। অন্যদিকে সম্রাটের কাছ থেকে তিনি মাসে ১০ লাখ টাকা নিতেন বলে গতকাল প্রচারমাধ্যম জানিয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে মেননকে অবগত করেই মতিঝিল ও আরামবাগের বিভিন্ন ক্লাবে চালানো হয় অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা।

র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত সম্রাট জানান, গত সংসদ নির্বাচনের আগে রাশেদ খান মেনন এককালীন কয়েক কোটি টাকা নেন তার কাছ থেকে। পার্টি ফান্ডে নির্বাচনী ডোনেশন হিসেবে নেওয়া হয় এই টাকা। পোস্টার ছাপানো থেকে শুরু করে নির্বাচনী ক্যাম্প বানানো, মাইকে প্রচারের আয়োজনও করেন সম্রাট। বহিষ্কৃত আরেক নেতা যুবলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদের মাধ্যমে নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কিত খরচের বিল দেওয়া হতো। সম্রাট ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতেও সহযোগিতা করবেন মেনন- জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যও ফাঁস করেন তিনি।

বিগত সরকারের মন্ত্রী থাকাকালীন তখনকার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে হজব্রত পালন করেছিলেন রাশেদ খান মেনন। তা ওই সময়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। বর্তমানের ‘নরম-গরম’ বিবৃতির ফলে তার ‘হাজি’ পরিচয়কে নতুন করে সামনে আনছেন ফেসবুকাররা।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় ডাক ও তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন মেনন। এর পরে পান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার বেশ কয়েকটি বই। ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন তিনি। চীনপন্থি রাজনীতিতে দীক্ষিত এবং মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ভাবশিষ্য মেনন ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন; ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে পালন করেন অনন্য ভূমিকা। অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধেও। পাকিস্তান আমলে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলার’ কথা বলার জন্য সাত বছর সশ্রম কারাদ- ভোগ করেন। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনীত করা হয় তাকে।

আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। মধ্য আশি ও নব্বই দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও ছিল তার উজ্জ্বল ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকার বাংলামোটর থেকে মগবাজার মোড় পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে- রাশেদ খান মেনন সড়ক।

সে সময়ে বুদ্ধিজীবীরা সরকারের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছিলেন, জীবিত যে কোনো ব্যক্তির নৈতিক স্খলন যে কোনো সময়ে ঘটতে পারে। সুতরাং জীবিত কারও নামে সড়ক কিংবা স্থাপনার নামকরণ না করাই শ্রেয়।

বাংলামোটর-মগবাজারের স্বল্পদৈর্ঘ্য সড়কটির ‘ভবিষ্যৎ’ অন্ধকার নাকি রোদ্রোজ্জ্বল সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ স্থিতিশীল হলেই দেদীপ্যমান হবে, সত্য কিংবা মিথ্যাটুকু!

ফেসবুকেও সমালোচিত মেনন
হজ পালন করে আসা রাশেদ খান মেনন বরিশালে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটাও অনেকটা ইসলাম ধর্মের বক্তব্যের আদলেই। ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি’ এমন বাক্য ধর্মীয় বক্তব্য তথা সুরা-কেরাতেই দেখা যায়। মেননের এমন বক্তব্য তথা সরকারের সমালোচনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাসে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেকেই।

সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদ লিখেছেন- ‘ওয়ার্কার্স পার্টির ভেতরে সমস্যা। সামনে সম্মেলন জাতীয় কিছু আছে। মন্ত্রিত্ব নাই, ক্যাসিনো নাই। পার্টির নেতৃত্ব তো ধরে রাখতে হবে।’

হজ পালন করে আসা রাশেদ খান মেনন বরিশালে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটাও অনেকটা ইসলাম ধর্মের বক্তব্যের আদলেই। ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি’ এমন বাক্য ধর্মীয় বক্তব্য তথা সুরা-কেরাতেই দেখা যায়। মেননের এমন বক্তব্য তথা সরকারের সমালোচনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের স্ট্যাটাসে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেকেই।

সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদ লিখেছেন- ‘ওয়ার্কার্স পার্টির ভেতরে সমস্যা। সামনে সম্মেলন জাতীয় কিছু আছে। মন্ত্রিত্ব নেই, ক্যাসিনো নেই। পার্টির নেতৃত্ব তো ধরে রাখতে হবে।’

সাংবাদিক নেতা শামছুদ্দীন আহমেদ লিখেছেন- ‘মন্ত্রী থাকলে কি মেনন এ কথা বলতেন?’ এ আবার কেমন প্রশ্ন? তাহলে কি মন্ত্রী হওয়ার কারণে অন্যরা চুপ? আজব দেশের আজব বচন।’

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা লিখেছেন, ‘উনি কি কমরেড না উনার কম রেট?’

এরকম নানা আলোচনা-সমালোচনায় সরগরম ফেসবুক। টাইমলাইনে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ফুলকি।

মন্ত্রী হলে কি মেনন এ কথা বলতেন : ওবায়দুল কাদের
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মন্ত্রী হলে মেনন এ কথা বলতে পারতেন কিনা। বক্তব্যের বিষয়ে ১৪ দলের সমন্বয়কের (মোহাম্মদ নাসিম) কাছে জানতে চাওয়া হবে।

গতকাল রোববার সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি এ সব কথা বলেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেনি বলে ১৪ দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বক্তব্য নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন কাদেরকে।

মেননের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, তিনি যদি বলেই থাকেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে এতদিন পরে কেন? এই সময়ে কেন? নির্বাচনটা তো অনেক আগে হয়ে গেছে। আরেক প্রশ্ন সবিনয়ে- মন্ত্রী হলে কি তিনি এ কথা বলতেন? আর কোনো কিছু বলতে চাই না।

আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে মেননের কাছে জানতে চাওয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নে কাদের বলেন, আমাদের ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম সাহেব, সেটা আমরা তার কাছে জানতে চাইব।

ক্যাসিনোকা- বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, এটি তাকে (মেননকে) জিজ্ঞাসা করলে ভালো হয়, তিনি কেন ক্যাসিনোকা-ের পর এ কথা বললেন, ইলেকশনের পর কেন বললেন না।

আমি মেননকে ধন্যবাদ জানাই : ড. কামাল হোসেন
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, আমি বারবার বলে যাচ্ছি, এ পর্যন্ত একজনও পাইনি যে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। দেরিতে হলেও রাশেদ খান মেনন বলেছেন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি খুশি। রোববার দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

দেশে গণতন্ত্র থাকলে মিটিং-জনসভা করার অধিকার থাকতো উল্লেখ করে কামাল হোসেন বলেন, আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি এখনো পাইনি। দাবি জানাচ্ছি, অনুমতি দ্রুত দেওয়া হোক। কেননা, এটা কোনো দয়ার ব্যাপার না; সাংবিধানিক অধিকার। সংগঠন করার, ঘোরাফেরার, সমাবেশ করার ও সমাবেশে মুক্তভাবে বক্তব্য রাখার অধিকার সংবিধানে স্পষ্টভাবে লেখা আছে। রক্তের বিনিময়ে এই সংবিধান পেয়েছি।

আগামী ২২ অক্টোবর জনসভার অনুমতি দ্রুত দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ড. কামাল বলেন, ২১ তারিখ রাতে অনুমতি দিলে ২২ তারিখে সমাবেশ করা কঠিন। ২০ তারিখ হয়ে গেছে, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমরা জনগণের কথা, ঐকমত্যের কথা তুলে ধরবো। এখানে কোনো সংঘাত-সংঘর্ষ বা বিরোধের ব্যাপার নেই।

এ সময় দেশ ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছে মন্তব্য করে জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর বর বলেন, সরকার শুধু সংবিধান নয়, কোনো বিধানই মানছে না। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কারাগারে। পুরো জাতি আজ উৎকণ্ঠিত। যে কোনো সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
মেননকে ডেকে জবাব চাওয়া হবে : মোহাম্মদ নাসিম

গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি- ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের এমন বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেন, ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতির এমন বক্তব্য দেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তার কাছ থেকে সবসময় দায়িত্ববোধ থেকে বক্তব্য আশা করি। ১৪ দলের মিটিং ডেকে এর জবাব চাওয়া হবে।

রোবাবার দুপুরে তার নির্বাচনী এলাকা সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রমের শুরুতে সূচনা বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

নাসিম বলেন, মেননের ওই বক্তব্য ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। ১৪ দলের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। জনগণ ভোট দিয়ে সরকার প্রতিষ্ঠার এক বছর পর তিনি কেন এ কথা বললেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করছে। জনগণ ভোট দিয়েছেন বলেই রাশেদ খান মেনন এমপি হয়েছেন। আমরা তার বক্তব্যে বিস্মিত।

মেনন সাহেবের বিষয়টি তদন্তাধীন তাই মন্তব্য করতে চাই না : ড. হাছান মাহমুদ
এমপি রাশেদ খান মেননের ক্যাসিনো-সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘কয়েকটি পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে আমিও বিষয়টি দেখেছি, তবে বিষয়টি তদন্তাধীন। তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না।

রোববার ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী একথা বলেন। রাজধানীর কাকরাইলে নবনির্মিত তথ্য ভবন মিলনায়তনে গণযোগাযোগ অধিদফতর এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের মূল বিষয় ছিল সরকারি প্রচার কার্যক্রমে উদ্ভাবন ও সেবা সহজীকরণ। অনুষ্ঠানে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান ও তথ্যসচিব আবদুল মালেক উপস্থিত ছিলেন।

ড. হাছান মাহমুদ বলেন, যারা ক্যাসিনো পরিচালনা করত তাদেরই ধরা হয়েছে। সবাই দুর্নীতিবাজ। ক্যাসিনো অবৈধ। বড় বড় রাঘব-বোয়ালকেই ধরা হয়েছে। এখন আরও অনেকের নাম আসছে। যারা অভিযোগগুলো করছেন, বড় বড় কথা বলছেন, তাদের নামও আসছে। এটি চলমান আছে। প্রধানমন্ত্রী দেশকে পরিশুদ্ধ করার জন্য, দেশ থেকে অনিয়ম দূর করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ধীরে ধীরে দায়ী সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, খড়কুটো আঁকড়ে ধরা ঐক্যফ্রন্ট জনগণের সাড়া পাচ্ছে না। তারা (ঐক্যফ্রন্ট) সমাবেশ করতে যাচ্ছেন, বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন করতে যাচ্ছেন- এই জন্য তাদের অভিনন্দন। কারণ, আমরা চাই রাজপথে এবং সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকুক। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে, তারা এই সব সভা-সমাবেশ করে জনগণের কোনো সাড়া পাচ্ছে না এবং কোনো ইস্যুও খুঁজে পাচ্ছে না।

সরকারের দেশ পরিচালনার নৈতিক অধিকার নেই- বিএনপির এহেন মন্তব্যের প্রতি তথ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমরা আজকে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে পরপর তিন তিনবার নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করার দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছি। বিএনপি তো ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই বলে আসছে দেশ পরিচালনায় সরকারের কোনো নৈতিক অধিকার নেই। বিএনপির এটি কোনো নতুন কথা নয়, এটি পুরনো বুলি। পুরনো ঢোলই তারা বাজাচ্ছে, এই ঢোল আমরা গত ১১ বছর থেকে শুনে আসছি।

জেলা তথ্য অফিসারদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রী বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে সরকারের সঙ্গে জনগণের সেতুবন্ধ রচনা করা এবং দেশ ও জাতির প্রয়োজনে একটি ন্যায়ভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা। সেই লক্ষ্যেই গণযোগাযোগ অধিদফতর দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। গত দশ বছরে প্রচার-প্রচারণার ক্যানভাস অনেক পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সময় এসেছে পুরনো ধাঁচের প্রচার কার্যক্রম বদলে ফেলে আধুনিক যুগোপযোগী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করার।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের লক্ষ্য, একটি উন্নত রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি একটি উন্নত জাতি গঠন করা, উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, শুধুমাত্র বস্তুগত উন্নয়ন দিয়ে উন্নত জাতি গঠন করা সম্ভব নয়। উন্নত জাতি গঠন করার জন্য সমাজকে উন্নত করতে হবে। প্রচার-প্রচারণার অংশ হিসেবে জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে মূল্যবোধ, মানবিকতা ও দেশপ্রেমের বার্তা।

তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান তার বক্তব্যে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে একাগ্রভাবে কাজ করতে হবে। গণযোগাযোগ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে অধিদফতরের কর্মকর্তাবৃন্দ ও দেশব্যাপী ৬৮ তথ্য কর্মকর্তা অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

মহাসত্যটি স্বীকার করেছেন মেনন : রুহুল কবির রিজভী
একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের করা মন্তব্যকে ‘মহাসত্য’ বলেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেছেন, ‘নিশিরাতের সরকারের সঙ্গী রাশেদ খান মেনন যে কোনো কারণেই হোক, এবার নিজের মুখে মহাসত্যটি স্বীকার করেছেন।’ রোববার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন রুহুল কবির রিজভী।

এর আগে গত শনিবার বরিশালে ওয়ার্কার্স পার্টির বরিশাল জেলা শাখার সম্মেলনে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। এর বড় সাক্ষী আমি নিজেই। আজ মানুষ তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত।’

রাশেদ খান মেননের এই বক্তব্য প্রসঙ্গে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘অবশেষে সত্য কথাটা অকপটে জনগণের সামনে স্বীকার করতে হলো মেনন সাহেবকে। বিবেকের তাড়নায় মেনন সাহেব যে সত্য কথাগুলো বলতে শুরু করেছেন, হয়তো কয়েক দিন পর ওবায়দুল কাদের এবং হাছান মাহমুদরাও বলবেন। আর এই কথাগুলো যতই তাদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসবে, ততই বন্ধক রাখা আত্মা মুক্ত হবে।’

বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘কথায় বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। সত্যকে কখনো ধামাচাপা দেওয়া যায় না। সত্য কোনো না কোনোভাবে প্রকাশিত হয়ই।’

 
Electronic Paper