রোহিঙ্গায় পরিবেশ সমস্যা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’
শফিক হাসান
🕐 ১০:৩১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৯, ২০১৯
মানবিক কারণে মিয়ানমারের নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ; বর্তমানে উপকারের মাশুল নানাভাবেই দিচ্ছে বাংলাদেশ! অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশ-প্রকৃতির ধ্বংসের মতো নেতিবাচক ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। কক্সবাজারের বাসিন্দাদের প্রাত্যহিক জীবনেও পড়ছে এর প্রভাব। রোহিঙ্গাদের উপস্থিতিতে স্থানীয়রা নানাভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন; শ্রমিকরা হারাচ্ছেন কাজের সুযোগ। বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি। একশ্রেণির রোহিঙ্গা কিছু চিহ্নিত সংগঠন ও ব্যক্তির ইন্ধনে জড়িয়ে পড়েছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। মাদক ব্যবসাসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের হত্যার মতো ধৃষ্টতাও দেখাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না রোহিঙ্গাদের। বিদেশে পালানোর পাঁয়তারা চালানোর পাশাপাশি তারা মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে মূল জনস্রোতে।
কক্সবাজার বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা হলেও রোহিঙ্গাদের আবাস গাড়ার পর ক্রমশ সুনাম হারাচ্ছে। গাছপালা নিধন, পাহাড় কর্তনে পরিবেশ-জলবায়ু পড়ছে হুমকির মুখে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের আবাসন তৈরির জন্য কাটছে হয়েছে প্রচুর গাছ, নষ্ট হয়েছে পাহাড়ে স্বাভাবিক আকৃতি। বৃষ্টি-অতিবৃষ্টির ফলে আরও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিবেশ সমস্যা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গতকাল শনিবার তিনি খোলা কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের অবস্থানের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। কারণ হচ্ছে, ওটা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে থাকা একটা এলাকা। ওখানে বন উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে ইতোমধ্যেই গরম বেড়ে গেছে। কক্সবাজারের পাহাড়গুলো ধসে পড়বে, নদীগুলোও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছবে। বন উজাড় হওয়ার ফলে সেখানে হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। এগুলোর ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব ওই এলাকায় পড়ছে তা আরও তীব্রতর হবে।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকের কাছে আদরণীয় স্থানটি ঐতিহ্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বেলার প্রধান নির্বাহী আরও বলেন, পর্যটনে হয়তো অচিরেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না; আগামী দুই-এক বছরের মধ্যেই সরাসরি সামনে আসবে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া বনগুলো পর্যটন এলাকায় অবস্থিত নয়। তবে ধারাবাহিকভাবে কক্সবাজারের পানি দূষিত হওয়া শুরু করবে, পানির স্বল্পতা দেখা দেবে। কারণ রোহিঙ্গাদের পানি সরবরাহ করতে হচ্ছে। ফলে কক্সবাজার শহরে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে পর্যটকরা গিয়ে পানি পাবেন না। তখন অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ রিজওয়ানা হাসান।
ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেতের বিষয়টি আমলে নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে একটি কমিটি। একাদশ জাতীয় সংসদের ‘পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি’র অষ্টম বৈঠক গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় কক্সবাজারে। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে পরিবেশ, বন এবং জীব-বৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। নতুন করে আর ক্ষতি হতে দেওয়া হবে না। বিশেষজ্ঞ দিয়ে ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করে, তা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে সাবের হোসেন চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় ১০ হাজার গভীর নলকূপ থেকে প্রতিদিন পানি উত্তোলন করায় পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে বিভিন্ন স্থানে পানি সংকট প্রকট হচ্ছে; ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন না করে ভূমির উপরিভাগের পানি ব্যবহারের কৌশল গ্রহণের ওপর জোর দেন তিনি।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেন, নতুন করে পাহাড় কাটা, বন নিধনসহ নানাভাবে পরিবেশ ধ্বংস করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কক্সবাজারের পরিবেশ রক্ষায় দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন তিনি। রোহিঙ্গাদের জন্য পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হয় অষ্টম সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায়।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনসহ রাষ্ট্রগুলো যেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দিত করেছিল, সাধুবাদ জানিয়েছিল মহানুভবতার- শেষপর্যন্ত তা থেকে গেছে কথার কথা হিসেবেই। বাংলাদেশ পাশে পায়নি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র চীন-ভারতকেও। মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগসহ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বহির্বিশ্বের তেমন কেউই উদ্যোগী হয়নি। অন্যদিকে মিয়ানমার সরকার নানা কূটকৌশল প্রয়োগ করে সময়ক্ষেপণ করছে। নতুন করে আশ্রিত প্রায় সাত লাখ শরণার্থী, আগে বিভিন্ন সময়ে এসেছে আরও প্রায় চার লাখ- সব মিলিয়ে ১১ লাখ উদ্বাস্তুর চাপে বিপর্যস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। দেশে বিরাজ করছে বেকারত্বসহ নানামাত্রিক সংকট; এ অবস্থায় সিন্দাবাদের ভূত হয়ে ঘাড়ে চেপে থাকা রোহিঙ্গারা বোঝার উপর শাকের আঁটিতুল্য। হাতিয়ার ভাসানচরে তাদের জন্য আবাসন প্রকল্প করা হলেও সেখাতে যায়নি রোহিঙ্গারা। চুক্তি অনুযায়ী, ফেরত যেতে সম্মত হয়নি মিয়ানমারেও। বাংলাদেশেরই কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি ও সংগঠনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চিহ্নিত মহল জড়িত সমস্যা জিইয়ে রাখার পাঁয়তারার নেপথ্যে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ধ্বংসই নয়, রোহিঙ্গা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা না গেলে নানাভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার না করায় রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে ঘটে চলেছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ। জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে আরও বেশি মাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পরিবেশ-প্রকৃতিতেও। প্রকৃতি রক্ষাই শুধু নয়, বাংলাদেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অধিকার রক্ষার জন্যও সমস্যাটি সমাধানের বিকল্প নেই।