মুক্তিযোদ্ধা ড. জাহিদের আত্মহত্যা
এ কেমন মৃত্যু, কে নেবে দায়?
প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ১০:৪৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০১৯
মুক্তিযোদ্ধা ড. জাহিদ হোসেন প্রধান। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেন। স্বাধীনতার পর দেশগঠনেও অবদান রাখেন এই বিজ্ঞানী। ‘জুট জিও টেক্সটাইল’ আবিষ্কারের অবদান হিসাবে পান রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে লিখেছেন, সম্পাদনা করেছেন বই। ছিলেন উদ্যেমী একজন সংগঠক।
আবাসন ব্যবসায় নেমে রাজধানীতে নির্মাণ করেন বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন। অথচ গত চার বছর তাকে ঠাঁই নিতে হয়েছিল অফিস কক্ষে। আজীবনের এই যোদ্ধাকে শেষটাই হার মানতে হয়েছে জীবনযুদ্ধে। ঋণের বোঝা, পরিবারের অসহযোগিতা, কাস্টমস কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ- নিসঙ্গতা, হতাশা আর অপমানের হাত থেকে বাঁচতে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। বাড়ির একটি ফ্লাটে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন জাহিদ প্রধান। ১৯৯২ সাল থেকে ফ্লাটটিই তার আবাসন কোম্পানি আর্কেডিয়া প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। ২০১৫ সালে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে এই অফিসেই নিঃসঙ্গ বসবাস করছিলেন জাহিদ।
প্রেসিডেন্ট গ্লোরি আর্কেডিয়া নামের ওই ভবনের ম্যানেজার হারুন ওর রশীদ। জাহিদ প্রধান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘স্যার (জাহিদ প্রধান) খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। আমাদের খুব স্নেহ করতেন, কোন দিন তার কাছ থেকে খারাপ কোন আচরণ পাইনি। অনেক সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। আর তার মনটা ছিল খুব নরম।
হারুন বলেন, ‘এ বাসাতে তিনি একাই থাকতেন। তার ছেলে কানাডায় থাকেন, স্ত্রী আর মেয়ে মোহাম্মদপুরে নিজ বাড়িতে থাকতেন। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তেমন কোন যোগাযোগ ছিল না। তিন বছর ধরে আমি এখানে কাজ করি, কখনো তার পরিবারের কাউকে এখানে আসতেও দেখিনি।’
১৯৯৪ সালে জুট জিও টেক্সটাইল ও জাহিদ’স মডেল আবিষ্কারের জন্য রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হন ড. জাহিদ হোসেন প্রধান। এ বিষয়ে হারুন বলেন, ‘তিনি অনেক বড় বিজ্ঞানী ছিলেন। জাতীয় জাদুঘরে তার আবিষ্কার বিষয়ক ছবি সংরক্ষিত আছে। ২৪ সেপ্টেম্বর যেদিন জাহিদ প্রধান আত্মহত্যা করেন সে দিনকার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হারুন বলেন, ঘটনার দিন সকালে তিনি অফিস যাচ্ছেন বলে জানান। এ সময় তার মন খুব খারাপ ছিল। আমাকে তিনি বলেন, ‘কেউ খোঁজ নিতে আসলে বলো আমি বাসায় নেই।’ ওই দিন দুপুরে জাহিদ প্রধান বাসায় আসেন। তার দেখাশোনার জন্য ছোট্ট একটি ছেলে ছিল। ওই ছেলেটিকে ডেকে ভাত দিতে বলেন। ভাত রান্না করে প্লেটে বেড়ে জাহিদ প্রধানকে ডাকতে গিয়ে দেখতে পায় ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছেন তিনি।
ঋণে জর্জরিত ছিলেন জাহিদ প্রধান : রাজধানীতে অসংখ্য ভবন নির্মাণের কাজ করেছে জাহিদের মালিকানধীন আবাসন প্রতিষ্ঠান আর্কেডিয়া প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড। শেষ সময়ে এসে একটি প্রকল্পের জন্য ব্যাংক লোন নেন তিনি। সেই প্রজেক্টের কাগজপত্র ব্যাংকে মর্টগেজ ছিল। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজটি পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি তিনি। এ অবস্থায় প্রকল্পের মালিকপক্ষ ব্যাংককে চাপ দেয় মর্টগেজ ছাড়ানোর জন্য। ব্যাংকও জাহিদকে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকে।
এক পর্যায়ে ব্যাংক টাকা উদ্ধার না করতে পেরে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে অভিযোগ করে। ঘটনার তদন্ত শুরু করে কাস্টমস। জানা যায়, জাহিদ প্রধানের মোহাম্মদপুরের বাড়িসহ সব সম্পত্তি তার স্ত্রী-পরিবারের নামে ছিল। এজন্য ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় তার ছিল না। আত্মহত্যার দুদিন আগে কাস্টমসের লোকজন জাহিদ প্রধানকে প্রেসিডেন্ট গ্লোরি আর্কেডিয়া ভবন থেকে ডেকে নিয়ে যায়। ওই ভবনের একাধিক বাসিন্দা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, ওই দিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত জাহিদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। ঋণ পরিশোধ করতে তার পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন তারা। কিন্তু এতে জাহিদের পরিবার অপারগতা প্রকাশ করেন। তারা জানান, ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টায় কাস্টমসে যাওয়ার কথা ছিল জাহিদের। ওই দিন বারবার কাস্টমস থেকে তার কাছে ফোনও আসে।
প্রেসিডেন্ট গ্লোরি আর্কেডিয়া ভবনের সেক্রেটারি আফরোজ বেগম বলেন, জুট জিও টেক্সটাইল আবিষ্কার করে রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছিলেন ড. জাহিদ। এত খ্যাতনামা একজন বিজ্ঞানী এভাবে নিজের জীবন শেষ করে দেবেন এটি মেনে নেওয়া কষ্টকর। তার অনেক অর্জন ছিল, কিন্তু শেষ জীবনে এসে ঋণে জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যা করে বসলেন।
জাহিদ প্রধানের আত্মহত্যার ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। আইনি কার্যক্রম শেষে এই মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল : ১৯৯৪ সালে জুট জিও টেক্সটাইল ও জাহিদ’স মডেল আবিষ্কারের জন্য রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হন ড. জাহিদ হোসেন প্রধান। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নীলফামারী-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ছিলেন তার শ্যালক মনিরুজ্জামান মন্টু। এ ঘটনায় জাহিদের সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সম্পর্কের টানাপড়েন দেখা দেয়। পরবর্তীতে নানা কারণে শ^শুরবাড়ির পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে।
২০১৫ সালে স্ত্রীর সঙ্গেও তার সম্পর্কের অবনতি হয়। এর আগ থেকেই আর্থিক সংকটে পড়েন জাহিদ প্রধান। যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেখানে কয়েকমাসের বাসা ভাড়া বকেয়া পড়ে। এ অবস্থায় তার স্ত্রী চলে যান তাদের মোহাম্মদপুরের বাড়িতে। এ বাড়িটি স্ত্রীর নামেই রাখেন জাহিদ। আর নিজে চলে যান ধানমন্ডির ৪ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর বাড়িতে। নিজের অফিসে একটি খাট পেতে একাই থাকতেন তিনি।
নীরব পরিবারের সদস্যরা : জাহিদ প্রধানের আত্মহত্যার ঘটনায় নীরব রয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। তার শ্যালক মনিরুজ্জামান মন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। যেহেতু তিনি আর জীবিত নেই, তাই আমি তার স্ত্রী, পুত্রের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারছি না।’
পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাইলে, তাতে অপারগতা প্রকাশ করেন মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘দুঃখিত আমি কিছুই করতে পারছি না। আমি এখন চট্টগ্রামে আছি।’ জাহিদের স্ত্রী নাজমা বেগমের মোবাইল নাম্বারে ফোন দিলে সেটি আর ব্যবহৃত হচ্ছে না এমনটা জানা যায়।
ব্যক্তিজীবনে উজ্জ্বল নক্ষত্র : জাহিদ হোসেন প্রধানের জন্ম ১৯৫৪ সালে নীলফামারীতে। পিতা মরহুম আশরাফুর রহমান প্রধান ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে তার অবস্থান ষষ্ঠ। ছোটবেলা নীলফামারীতে কেটেছে। কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি ও আইএ পাস করার পর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন রাশিয়ার মস্কোতে। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জাহিদ। ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কনসালটেন্ট হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন নীলফামারী জেলা সমিতি ঢাকার সাধারণ সম্পাদক এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জাহিদ হোসেন প্রধান ১৯৯৪ সালে জুট জিও টেক্সটাইল ও জাহিদ’স মডেল আবিষ্কারের জন্য রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হন। দেশ-বিদেশে তার আবিষ্কার ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। তিনি বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইরোসন কন্ট্রোল এসোসিয়েশন (আইইসিএ), ইন্টারন্যাশনাল জিওসিনথেটিক সোসাইটি, ভারতের এশিয়ান সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্টাল জিওটেকনোলজিসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্য ছিলেন। দেশে বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে তার বহু সংখ্যক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
শিক্ষাবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রধানের নাম বিশ্ব সাহিত্য ভবন থেকে প্রকাশিত শিশু-কিশোর মানচিত্র বইয়ে বাংলাদেশের কৃতি সন্তান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত আছে। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বহির্পরীক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। মস্কোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষাকতা করেন তিনি। সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউটে দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করেন। পাশাপাশি মহাকাশযান ডিজাইনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।