মাল্যবান
বিমূর্ত শিল্পকলার গভীরতা
অরিজিৎ ভট্টাচার্য
🕐 ১২:৩৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০১৯
বাংলা সাহিত্যে যে-সব বিদেশি লেখকের অভিঘাত ও দুর্মর প্রভাব লক্ষ করা যায় তাদের মধ্যে স্যামুয়েল বেকেট অন্যতম। আর বেকেটের যে রচনাটি বিশ্বসাহিত্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত, এবং আলোচ্য বাংলা উপন্যাসটির পাশে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সেই ‘ওয়েটিং ফর গোদো’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। আর জীবনানন্দ দাশের ‘মাল্যবান’ এর রচনাকাল ১৯৪৮। এই তথ্য আবিষ্কার করে যেমন শিউরে উঠছি, তেমনি ভেবে অবাক হচ্ছি যে পৃথিবীর যে-কোনো অংশের পাঠকের চেয়ে বাঙালি পাঠক কত বেশি নিরুত্তাপ, আত্মবিশ্বাসহীন।
অনেকেই বলে থাকেন ‘মাল্যবান’ আর কেউ নন, স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ। আর এই উপন্যাসটি একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস। যারা তার দিনলিপি পড়েছেন, তারা আরও বেশি করে মানেন এ কথা। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর প্রকাশিত লেখাগুলো যখন প্রকাশিত হচ্ছিল, কবিপত্নী লাবণ্য দাশ ‘মাল্যবান’ তখন প্রকাশ করতে চাননি।
জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহর লেখা থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়। জীবনানন্দ গবেষক ক্লিনটন সিলির জীবনানন্দের সাহিত্যিক জীবনীগ্রন্থ ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’-এ জীবনানন্দের দাম্পত্য জীবনের সঙ্গে শুধু ‘মাল্যবান’ উপন্যাসের মিল খুঁজে বের করেননি, তিনি চরিত্র, পদবির নামগুলোর মিলও খুঁজে পেয়েছেন। এসব মিলিয়ে ‘মাল্যবান’কে জীবনানন্দ দাশের দাম্পত্য জীবনের প্রতিচ্ছবি বলা যেতেই পারে।
‘মাল্যবান’ এর বিষয়বস্তু এক দাম্পত্যজীবন মাল্যবান আর উৎপলার যন্ত্রণাজর্জর সহাবস্থান। মাত্র কিছুকাল বিবাহিত জীবনের স্বাদ পেয়ে এমন এক স্তরে তারা এসে পৌঁছেছে যেখানে একে অন্যের কাছে ধোঁয়াটে। মাল্যবান ভিন্ন ঘরে শুয়েও রাত্রিরে অস্থির হয়ে ঢুকে পড়ে স্ত্রীর ঘরে, বিবাহের তারিখে উৎপলার শরীরের স্বাদ পাওয়ার তীব্র নেশা তাঁকে পেয়ে বসে, অন্যদিকে উৎপলার নির্জীব নিরাসক্তি এক মেরুপ্রমাণ বিভক্তির দিগন্তে নিক্ষেপ করে মাল্যবানকে, যেখানে দাঁড়িয়ে মাল্যবান বুঝতে চায় এক অদৃশ্য মহাশিল্পীর অনন্ত রহস্যময় সৃষ্টিতত্ত্ব, বিড়াল-বিড়ালী-ইঁদুর-কি-পাখির ডিম হয়ে ওঠে যন্ত্রণার তীক্ষ অনুসন্ধেয় চিত্রকল্প। কিন্তু না, সবকিছুর উত্তর পায় না সে। উৎপলা এবং মাল্যবান মুহূর্তের কোনো নরম অনুভূতির দ্বারা আক্রান্ত নয়, সব ঘটনার ঊর্ধ্বে যেন তারা। আর এই উপন্যাসটিতে ঘটনা যা-ও-বা ঘটছে তা খুবই ক্যাজুয়াল, তার যেন কোনো গতি নেই। অথচ কোনো কোনো মুহূর্তের স্পন্দনকেও যেন নিঃসাড় করে রেখেছেন লেখক। তাই শ্রীরঙ্গের আকস্মিক উপস্থিতি ও কথাবার্তায় মোচড় অনুভব করলেও উৎপলার কোনো গ্রন্থি উন্মীলিত হয় না। বেহালার সুর-মূর্ছনায় শ্রীরঙ্গ যখন হঠাৎ করে বলে বসে- ‘কিন্তু হাতি খাচ্ছ কেন, বলো তো কামিনী-’ তখন একটু বেসামাল হয়েও উৎপলা নিছকই প্রয়োজনের উত্তর দেয়, ‘কী খাব তাহলে?’
‘Instant’কে ‘Eternit করে তোলার গরজ নেই ঔপন্যাসিক জীবনানন্দ’র। অনন্ত মহাকালের বুকে ক্ষণকালের উদ্বেলতার কোনো মানেই খুঁজে পায় না তাঁর চরিত্ররা। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের প্রতিবেশী রমার মৃত্যু এবং তদুপলক্ষে শবানুগমন কোনোই ভাবান্তর ঘটায় না মাল্যবান-উৎপলার অন্তরে, কোনো সুদূর সাদৃশ্য-কি- বৈসাদৃশ্যের অর্থেও নয়। ‘একটি মৃতা- খুব অল্প বয়সেই- দগ্ধ হয়েছে শ্মশানে। একটি স্বামীর শোক খুবই জায়াকেন্দ্রিক, এখনো গভীর। কিন্তু এখনই তরল হয়ে যাচ্ছে সব; সচ্ছল সফল সময় ব্যথা, বাচালতা, সরসতা, নষ্টামি, ভয়, রক্ত, রিরংসা, অনাথ, অন্ধকার ও গভীরতার ভেতর মৃত্যু নয়, শূন্য নয়, ব্যক্তি জীবন নয়, অফুরন্ত অনির্বচনীয় সময়,-সময় শুধু।’
অথচ এক মুহূর্তের প্রেরণায়, ক্ষণিকের দৃষ্টি বিনিময়েই তো ‘বনলতা সেন’কে চিরন্তন কাব্য-প্রতিমায় রূপান্তরিত করেছিলেন তিনি। আসলে সেজন্য প্রয়োজন হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে শিল্পীসত্তার বোঝাপড়া, আবেগ ও মননের শ্রমসাধ্য অনুশীলন। কিন্তু উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীকে তিনি নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বশে চালাতে চাননি- খানিকটা কম্প্রোমাইজ জরুরি হয়ে পড়েছিল তাঁর।
আর তাই ইউরোপীয় সাহিত্যের আদর্শে সমকালীন বাংলাসাহিত্যে যখন কবি ও কবিতা, শিল্প ও শিল্পী সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে উঠছে, বোহেমিয়ানিজম-এর জোয়ারে নতুন ফসল ফলছে, এবং অন্যদিকে মার্ক্সীয় বুলি-বক্তৃতার তপ্ত আঁচে কেউ-কেউ শরীর-মন সেঁকে নিচ্ছে, তখনো মাল্যবান-উৎপলা শান্ত-স্থির থেকে মার খেয়ে চলেছে- খেয়ালী-বাউণ্ডুলে-ভবঘুরে-মদ্যপ কিংবা লম্পট হয়েও অস্তিত্বের স্বকীয়তা ঘোষণায় অপারগ; আত্মহত্যার স্পৃহা নেই, অথচ কোনো বৈরাগ্যবোধের ছোপও ধরে না তাদের হৃদয়ে। রোম্যাঁ রোল্যাঁ-র জাঁ ক্রিস্তফের মতো কোনো ভিন্ন সত্তায় মাল্যবানের উত্তরণ ঘটেনা, কিংবা জয়েস-এর স্টিফেন ডেডলাস-এর মতো শিল্পের কাছে পরমাশ্রয় খুঁজে পায় না সে- দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জীবনের দাসত্ব করার চেয়েও জীবনকে খাটিয়ে নিয়ে কোনো অমর সৃষ্টির লোভ জাগে না তার।
কেন-ই বা বেঁচে আছে মাল্যবান-উৎপলা? বেঁচে থাকতে চায়? বেকেটের চরিত্ররাও বেঁচে থাকে, অপেক্ষা করে থাকে গোদোর জন্য, আত্মহত্যা করতে গিয়েও থেমে যায়। গোদো যদি ঈশ্বরই হন তবে তো বেকেটের সোচ্চার বিদ্রুপ রয়েছে জীবনের প্রতি, ঈশ্বরের প্রতি; কিন্তু জীবনানন্দর চরিত্রদের কাছে এমন কোনোই আদর্শ বা আশা নেই, তথাপি লেখক দেখাচ্ছেন এভাবেই বেঁচে আছে তারা, বেঁচে থাকতে হয়, অথচ তবুও বেঁচে থাকতে চায়। বেকেট যন্ত্রণার Positive Value নির্ধারণে উৎসাহী, ঈশ্বরকে ‘Idiot’ ভেবেই শান্তি তাঁর (অবশ্য মানুষের দুক্ষ-দুর্দশা-দৈন্য-নৈর্বেদের জন্য ঈশ্বরকে মূর্খ বানিয়ে, কিংবা ঈশ্বর-বিশ্বাসী মানুষের প্রতি শ্লেষোক্তি করে আত্মশ্লাঘা অনুভবেও কোনো ‘Wisdom’ এর পরিচয় নেই!)। কিন্তু জগৎ ও জীবনের অপার রহস্যের কাছে কোনো কিছুকেই Positive বলে ধরতে পারেন না জীবনানন্দ, ধরতে চানও না বোধ হয়। মানুষের মনের অভ্যন্তরীণ জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি নয় শিল্প, স্নায়বিক বিকারের যন্ত্রণার অব্যর্থ শান্তির প্রলেপও নয় শিল্পকর্ম। সেসব মান্ধাতা-আমলী টীকা-বটিকার কাল গত হয়েছে। অন্তত ঔপন্যাসিক জীবনানন্দর আস্থা নেই সেসব জীবন-ভাষ্যে। আর পাশ্চাত্যের যন্ত্রমানব বেকেটের চেয়ে ও জীবনানন্দর হাতে যন্ত্রণা-কি-নের্বেদ অনেক বেশি গাঢ়, গভীর, এ ধারণায় কোনো উচ্ছ্বাস কিংবা অতিরঞ্জন নেই।
মাল্যবান যত অবাক হতে জানে তত অনুসন্ধান করতে পারে না, যদিও জানি অবাক হতে জানাটাই বড় কথা, শিল্প ও শিল্পীর পক্ষে জরুরি। অবশ্যই সাধারণের অবাক হওয়া আর শিল্পীর অবাক হওয়া সমার্থক নয়। ঔপন্যাসিক জীবনানন্দ যেন বোঝাতে চান যে বিশ্বজগতের অদৃশ্য স্রষ্টার মহাশিল্পের কাছে অবাক হওয়া বৈ মানুষের উপায় নেই। তাঁর অনন্ত চাতুরীর কাছে সব মানুষই মূর্খ।
কিন্তু তবুও মাল্যবানকে কখনো-কখনো মনে হতে পারে এক অতি দুর্বল জীব। মাল্যবান স্বপ্নে দেখে নিজেরই মৃত্যু, এবং কখনো বা উৎপলার স্বপ্ন দেখে ভাবিত হয় সে এবং এক তুড়িতে ফ্রয়েডকে উড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘পোষলার গাঁজলা বলেন স্বপ্নকে ফ্রয়েড। কিন্তু কী জানেন স্বপ্নের ফ্রয়েড? হ্বিয়েনার যত মৃগী রুগী আসতো তো তাঁর কাছে; তাদের কফিসেদ্ধর গরম-গরম সুরুয়া বানিয়ে তো আর মানবজীবনের তত্ত্ব বেরোয় না।’
কিন্তু মাল্যবান বুঝতে পারে না যে আসলে তাদের তাবৎ গুমড়ানো-একঘেঁয়ে জীবন থেকে মুক্তিলাভের তাড়নায়ই মনের অবচেতনের গভীরে জেগে ওঠে তার নিজের অথবা উৎপলার মৃত্যু-চিন্তা। মনের গতি-প্রকৃতির সূত্র অনুধাবনে অক্ষম মাল্যবানের তাই মনে হয়- ‘মানুষের মন সারাটা দিন-রাতের প্রথম দিকটায়ও- বোকা হ্যাংলার মতো চায়-অপেক্ষা করে, সাধনা করে, যেন নিজের কিছু নেই তার, অন্যে এসে দেবে তাকে, তবে হবে, কিন্তু গভীর রাতে বিছানায় শরীরই তো স্বাদ। শরীরটাই সব দেয় মানুষকে। মন কী? মন কে? মন কিছু নয়।’ কখনো কখনো মনে হয় মাল্যবান-উৎপলা রক্ত-মাংসের মানুষের সব স্বাভাবিকতাকে ছাড়িয়ে গেছে। স্ত্রী নিরাসক্ত জেনেও যেভাবে সে বেঁচে থাকে তার শারীরিক অতৃপ্তি নিয়ে, অন্য কোনো নারী অথবা বেশ্যাসক্ত না হয়েও, তাও তো অসম্ভব কোনো সুস্থ-সবল পুরুষের পক্ষে! উৎপলা সম্পর্কেও একই কথা। মনে হয়, মাল্যবান-উৎপলা নিছকই সংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালি! যাদের ধারণা এক পুরুষ অথবা স্ত্রী-তে স্থির থাকার নামেই চরিত্র।
অধিক ভোগের সামর্থ্য বা বাসনা তাদের নেই, কিন্তু সাধারণ প্রয়োজনটুকুও এরা মেটাতে পারে না! গীতা-মহাভারত-উপনিষদ-তন্ত্র, কোথাও তো চরিত্রের ওপর এমন নির্দেশ জারি নেই!
যে মাল্যবান সত্যকে বুঝতে চায়, তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব সাধারণ মানুষের এমন মিথ্যা ধারণা ও মনগড়া জীবনের মধ্যে স্থির হয়ে থাকা? ভোগেও নয়, ত্যাগেও নয়, এক অদ্ভুত সন্ধিস্থলে এরা দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য এসব বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার উত্তরে আবার বলতে হয়, এরা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি, অনেক কিছু জেনে-বুঝেও চোখ-কান বুজে সহ্য করতে হয় এদের অনেক কিছু, মন এদের দুর্বল, এভাবেই অব্যক্ত যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে থাকে এরা, বেঁচে থাকতে হয়-
এরা কেউ বীর-শিল্পী-সত্যদ্রষ্টা অথবা ঋষি নয়। আর এদের যথাযথ রূপায়ণেই জীবনানন্দ’র তৎপরতা লক্ষণীয়, নিজের রুচি-বোধ-কল্পনা দিয়ে তাদের ওপর আধিপত্য করে কোনো মনোরম আলেখ্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে।
আর এ কারণেই উপন্যাসটি আধুনিক বিমূর্ত শিল্পকলায় পাঠকের মনকে অথৈ গভীরতায় ছুড়ে ফেলে। দেখার এই কায়দাটা, বোধ করি, আলোচ্য উপন্যাসের পাঠকের পক্ষে একান্ত জরুরি।