সম্রাট ছিলেন সম্রাটের মতো
মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:২৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৪, ২০১৯
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের নামের সঙ্গে কাজের মিল ছিল। চালচলন ছিল সম্রাটের মতোই। খাবার খেতেন পাঁচতারকা হোটেলে, পান করতেন বিদেশি পানি, ছিল জলসাঘর। চলাফেরা করতেন সদলবলে। পথে বের হলে সামনে-পেছনে থাকত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের বহর।
ব্যাংকে রয়েছে কাড়ি কাড়ি টাকা। তার আয়ের প্রধান উৎস ছিল ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি আর চাঁদাবাজি। এই আয়ের কোটি কোটি টাকা তিনি বিদেশেও পাচার করেন। মালয়েশিয়ায় গড়েছেন সেকেন্ড হোম। সেখানে কোটি টাকা খরচ করে কিনেছেন ফ্ল্যাট, ব্যাংকে জমা করেছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। তবে এত কিছু থাকার পরও তিনি এখন ঢাকায় কারাগারে বন্দি। দেরিতে হলেও তার হাতে হাতকড়া লেগেছে।
জানা গেছে, গত ৬ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামের একটি বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। বর্তমানে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। ছাত্ররাজনীতি থেকে যুবলীগের রাজনীতিতে এসে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি হন সম্রাট। তার ক্ষমতার হাত ছিল বেশ লম্বা। সরকারি দলের বড় পদে থাকায় গডফাদার ভাবমূর্তির সম্রাট ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখতে কাড়ি কাড়ি টাকাও ঢালতেন।
সে কারণে ক্যাসিনোকাণ্ডে অনেকে ধরা পড়ার পরও সম্রাট ধরা পড়বেন কি-না, তা নিয়ে সংশয় ছিল দলসহ অনেকের ভেতরেই। সম্রাটকে গ্রেফতারে বিলম্ব দেখে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতার ছেলে এবং ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ফজলে নূর তাপস গত ৫ অক্টোবর এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তখন তিনি জানতে চান, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পরও কেন সম্রাটকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। তার বক্তব্যের পর রাত পোহাতে না-পোহাতেই আটক হন সম্রাট। আর এর মধ্যদিয়ে তছনছ হয়ে যায় সম্রাটের কোটি কোটি টাকার ক্যাসিনো-সাম্রাজ্য।
ক্ষমতাসীন দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি হওয়ায় সম্রাটের সঙ্গে অনেক মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে ভালো সখ্য ছিল। তাছাড়া প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সাংবাদিকসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ব্যক্তি যাদের সঙ্গে সম্রাটের সখ্য থাকার কারণে দলের মধ্যেও নিজের একচ্ছত্র দাপট ছিল। ঢাকায় দলীয় সমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করে লোক জড়ো করার দায়িত্ব ছিল তার। বিপুলসংখ্যক লোক জড়ো করতেন সম্রাট। যে কারণে দ্রুত যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন। এ কারণে সম্রাটকে শ্রেষ্ঠ সংগঠক ঘোষণা করেন ওমর ফারুক চৌধুরী। সব মহলে ভালো সম্পর্ক থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সম্রাটের ভয়ে তটস্থ থাকত।
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি
রাজধানীর জুয়াড়িদের কাছে সম্রাট বেশ পরিচিত ছিল ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ নামে। সম্রাটের নেশা ও ‘পেশা’ জুয়া খেলা। তিনি একজন পেশাদার জুয়াড়ি। প্রতি মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে যেতেন জুয়া খেলতে। সেখানে টাকার বস্তা নিয়ে যেতেন তিনি। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন জুয়াড়িরা। কিন্তু সেখানেও সম্রাট ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত। প্রথম সারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার বিশেষ ব্যবস্থাও আছে। এয়ারপোর্ট থেকে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনো পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিলাসবহুল গাড়ি ‘লিমুজিন’যোগে।
অফিসে রাজকীয়ভাব
সম্রাটের অফিস রাজধানীর কাকরাইলে রাজমণি সিনেমা হলের উল্টোপাশে। সেখানেই দলবল নিয়ে বেশিরভাগ সময় থাকতেন সম্রাট। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে চলত ভিআইপি জুয়া খেলা। প্রতিদিনই ঢাকার একাধিক বড় জুয়াড়িকে সেখানে জুয়া খেলার আমন্ত্রণ জানানো হতো। সেখানে সম্রাটের দাপট ছিল একচ্ছত্র, খেলার নিয়ম ছিল ভিন্ন। সেখান থেকে জিতে আসা যাবে না। কোনো জুয়াড়ি জিতলেও তার টাকা জোরপূর্বক রেখে দেওয়া হতো।
তিন বিয়ে
সম্রাটের তিনজন স্ত্রী রয়েছে। এর মধ্যে একজন বিদেশি স্ত্রী আছে বলেও জানা গেছে। সম্রাটের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাতে গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশ পায়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, সম্রাটের দুই স্ত্রী। প্রথম পক্ষের স্ত্রী বাড্ডায় থাকেন। প্রথম পক্ষে সম্রাটের এক মেয়ে। তিনি পড়াশোনা শেষ করেছেন। সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী মহাখালীর ডিওএইচএসে থাকেন। তার এক ছেলে। তিনি মালয়েশিয়ায় এক বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সিঙ্গাপুরে সম্রাটের বিদেশি একজন স্ত্রী আছে বলেও পারিবারিক সূত্রটি জানায়। তবে ওই স্ত্রীর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সূত্রটি জানিয়েছে, সম্রাট মহাখালীতে দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসাতেই স্থায়ীভাবে থাকতেন। তবে দুই বছর ধরে তিনি বাসায় যেতেন না। কাকরাইলে নিজের কার্যালয়ে থাকতেন।
মালয়েশিয়া সম্রাটের সেকেন্ড হোম
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের সেকেন্ড হোম মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার আমপাং তেয়ারাকুন্ড এলাকায় ফ্ল্যাট আছে বলে তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দেশটির সেকেন্ড হোম প্রকল্পের আওতায় এই ফ্ল্যাট কেনা হয়। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকেও সম্রাটের অ্যাকাউন্ট রয়েছে এবং লেনদেনের প্রমাণও মিলেছে বলে জানিয়েছে দুদক।
এ বিষয়ে দুদক সচিব দিলোয়ার বখত সাংবাদিকদের জানান, অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৪৩ জনকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের অর্জিত সম্পদের বিবরণী নেওয়া হচ্ছে। তারা যদি সঠিকভাবে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে না পারেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্জন ও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হতে পারে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার কর্মসূচি বা মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএম ২ এইচ) চালু হয় ২০০২ সালে। বাংলাদেশিরা সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শুরু করে ২০০৩ সাল থেকে। ওই বছর ৩২ জন বাংলাদেশি এতে অংশ নেয়। ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও বিএফআইইউ থেকে ১০ হাজার ৯১৭ জনের তালিকা পাওয়া যায়।
এর মধ্যে এসবির তালিকায় ১০ হাজার ৯০৪ জন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় ১৩ জনের নাম ছিল। দুদককে দেওয়া এসবির নথিতে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে ওই ১০ হাজার ৯০৪ জন মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করেছেন। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক।
অর্থ পাচারের তথ্য-প্রমাণসহ ১৩ জনের তালিকা দিয়েছিল বিএফআইইউ। তিন বছরের বেশি সময়ে দুদকের একাধিক টিম অনুসন্ধান করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নানা তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। সর্বশেষ উপ-পরিচালক (বর্তমানে পরিচালক) মো. জুলফিকার আলীর নেতৃত্বাধীন টিম অনুসন্ধান করে ১০ হাজার ৯১৭ জনের তালিকা থেকে ২৩ জনকে চিহ্নিত করে। ওই ২৩ জনের মধ্যে ১২ জনের নাম চিহ্নিত করা হয়েছে এসবির নথিপত্র যাচাই করে।
বিফআইইউর নথি যাচাই করে চিহ্নিত করা হয় ১১ জনের নাম। ওই ২৩ জনের তালিকায়ও সম্রাটের নাম ছিল। অনুসন্ধান দল তাদের প্রতিবেদনে সম্রাটসহ ওই ২৩ জনের অবৈধ সম্পদের বিষয়টি খতিয়ে দেখার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দিয়েছে।