আগামীর মানুষ
শেখ আনোয়ার
🕐 ১০:১১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৪, ২০১৯
আগামীর মানুষের ভাবমূর্তি আন্দাজ করতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বর্তমান সময়টায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া আবশ্যক। মানব সভ্যতার আজ পর্যন্ত যে উন্নতি হয়েছে এবং আরও যে অভাবনীয় উন্নতির দিকে আমরা এগোচ্ছি, তার প্রধানতম হাতিয়ার এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। বর্তমান প্রযুক্তির উদ্ভাসিত চোখ-ধাঁধানো উন্নয়ন, যুক্তি, কৌশল দ্রুতগতিতে পাল্টে দিচ্ছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন।
মানুষের জানা জগতের যাবতীয় সামাজিক নিয়মনীতি, মেধা ও মননকে মৌলিকভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমান সময়ের মানুষ, জ্ঞানবিজ্ঞানে স্বয়ংসম্পূর্ণ শক্তির অধিকারী। জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য বিজ্ঞান-প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে আরও অত্যাধুনিক হচ্ছে। বর্তমান আবিষ্কৃত বিজ্ঞানের কিছু কিছু নতুন ব্যবস্থা ইতোমধ্যে মানুষের জীবনে অঙ্গীভূত হয়েছে। বাকি কিছুর পূর্ণ রূপায়ণ মানুষ দেখতে পাবে অচিরেই এবং আগামী সহস্রাব্দের মধ্যে।
আগামী দিনের মানুষ সম্বন্ধে সহজ ভাষায় কিছু বলাটা মোটেও সহজ কাজ নয়। কারণ অনেক বিজ্ঞানীই অনেক রকম পূর্বাভাস দিয়েছেন। সবই বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর। কোনোটাই আজগুবী ব্যাপার নয়। বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক এইচ জি ওয়েল’স ‘দ্য টাইম মেশিন’ গ্রন্থে আগামী দিনে ‘অ্যালয়’ এবং ‘রোলক’ নামে দু’ধরনের বিকৃত মানুষের আগমনের কথা উল্লেখ করেছেন। আশ্চর্য হলেও সত্যি। এ যুগের বিজ্ঞানীদের মুখে যেন সে কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিক ড. অলিভার কারির কথাই ধরুন। তিনি বলেন, আগামী পঞ্চাশ হাজার বছরের মধ্যে মানবজাতি দুটো উপ-প্রজাতিতে বিভক্ত হবে। ভেঙে যাবে বর্তমানের মানব জাতি। একদিকে থাকবে ক্লোনিং বা জিনগত উচ্চ শ্রেণি। যারা হবে চৌকস এবং বিভিন্ন উত্তম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আরেক ভাগ হবে জিনগত দুর্বল। অনুর্বর বোধশক্তির। এরা হবে নিম্নশ্রেণির।
বয়স্করা শিখবে তরুণদের কাছে
চলতি সহস্রাব্দেই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের চূড়ান্ত চূড়ায় উঠবে মানব জাতি। স্বভাবগত আরাম প্রিয় মানুষের কোনো কষ্টকর কাজ আর থাকবে না। যারা শিক্ষা ছেড়ে দিয়েছেন বা ধারাবাহিক পেশাগত শিক্ষা গ্রহণ করে আপডেট হতে পারেননি, আগামীতে তারা পেশাগত সেকেলে হয়ে পড়বেন। তথ্য মতে, কাজের ক্ষেত্র পরিবর্তন হওয়ায় ২০৫০ সালের মধ্যে কোটি-কোটি মানুষ বেকার হয়ে যাবে। কারণ এ সময়ে পৃথিবীতে মানুষের প্রচলিত গৎবাঁধা নিয়মের প্রাত্যহিক কোনো কাজ থাকবে না। অটোমেশন তথা রোবটের মাধ্যমে কাজগুলো সম্পন্ন করা হবে।
পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের মতো দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে যাবতীয় দাফতরিক কাজ, হিসাব-নিকাশ ও প্রশাসনিক কাজ, সবই সম্পন্ন করবে রোবট। মানুষের জন্য অল্প যেসব কাজ থাকবে, সেসব কাজের ৮৫% ধরনের কাজ এখনো মানুষ শুরুই করেনি! তাই আগামী দিনে যার বয়স যত কম হবে সে দ্রুত নতুন প্রযুক্তি আয়ত্ত করবে। জ্ঞান, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সঙ্গে অল্প বয়সীরা বেশি পরিচিত থাকবে। ‘যিনি যতো বয়স্ক তিনি ততো বেশি অভিজ্ঞ।’ এমন চিরন্তন সত্যবাণী আগামী দিনে উল্টো হয়ে যাবে। বয়সে তরুণরাই বেশি সম্মানিত হবেন এবং বয়স্করা তরুণদের কাছে শিখতে আসবে।
গড়আয়ু হবে ১২০ বছর
শুধু কী তাই? বিজ্ঞানীদের মতে, কদিন বাদেই ক্লোনিং মানব সবখানে ছড়িয়ে যাবে। পৃথিবীতে ইচ্ছেমতো ডিজাইনকৃত বা কাস্টমাইজ করা মানুষের সন্তান জন্ম দেয়া সহজে সম্ভব হবে। তার আগেই ক্লোনিং করা পশুর মাংস, জেনেটিক রূপান্তরিত বা জিএম খাবার সর্বত্রই ব্যাপক প্রচলন ঘটবে। স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল চিকিৎসক আর সহজপ্রাপ্য ওষুধের ওপর বেশি নির্ভরশীলতার কারণে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়াবে ১২০ বছর।
বীমা কোম্পানিগুলো উচ্চ প্রিমিয়াম নির্ধারণে জেনেটিক স্ক্রিনিং পদ্ধতির সহায়তা নেবে। ইচ্ছামতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বানানো যাবে। এগুলো সহজেই শরীরে লাগানো যাবে। বায়োনিক চোখ, কান এমনকি কৃত্রিম জরায়ু তৈরি হবে। তৈরি হবে, কিডনি ও হৃৎপি-ও। ওদিকে প্রযুক্তির জোরে পুরো বিশ্বটা তখন হয়ে যাবে একটি শহর, একটি গ্রাম। স্যাটেলাইট হবে সেই শহরের ছাদ। বিশ্বের সব মানুষ হবে এই ছাদের নিচের বাসিন্দা। সভ্যতা হবে একটি শহরের সন্তান। এরই মাঝে এই বিশ্ব শহরে জন্ম নেবে কিছু মেধাবী ইচড়েপাকা দুরন্ত ও দুষ্টু তরুণ। ষোলো কলার পূর্ণতা থাকবে তাদের মধ্যে। ঘূর্ণায়মান স্যাটেলাইটের বদৌলতে এসব আদিম, বর্বরদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে মানুষের।
মানুষ হবে অতি বুদ্ধিমান
স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ‘ব্রাভো’তে প্রচারিত আগামী দিনে মানুষের বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী ড. কারি জানান, ‘নিকট ভবিষ্যতে মানবজাতিকে প্রযুক্তি নির্ভরতার মূল্য দিতে হতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশ্চর্যজনক কাজ এক সময় শেষ সীমানায় পৌঁছে যাবে। তখন সুস্থ স্বাভাবিক থাকার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করাটাই জটিল হয়ে পড়বে। শ্বাসরুদ্ধকর প্রযুক্তি বিরক্তি থেকে মুক্তির জন্য সব মানুষ নিরাপদ শান্তি খুঁজবে।
প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভশীলতার কারণে মানব প্রজাতির শুরু হবে এই ক্ষয়। মানুষ হতে পারে অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীর মতো। সমাজের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ, ওঠা বসার দক্ষতা, সেই সঙ্গে ভালোবাসা, সহানুভূতি, বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার মতো মানবিক অনুভূতিগুলো হারিয়ে যেতে পারে। মানুষ অন্যের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। দলবদ্ধভাবে কাজ করাও ভুলে যাবে। শারীরিকভাবে তারা হবে আরও তরুণ সুলভ।
প্রক্রিয়াজাত খাবার খেতে অভ্যস্ত হওয়ায় চিবিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন আর হবে না। তাই মানুষের চিবুকের আকারও কমে যাবে। মানুষের শারীরিক গঠন প্রজনন ক্ষমতা বাড়বে। পুরুষদের মুখের আকৃতি হবে প্রতিসম বা ভারসাম্যপূর্ণ। আবার মেয়েরা হালকা মসৃণ লোমবিহীন ত্বক, লম্বা, স্বচ্ছ উজ্জ্বল ঘন চুলের এবং আরও নানান সামঞ্জস্যপূর্ণ সৌন্দর্যময় বৈশিষ্ট্য ধারণ করবে।
মানুষের আকৃতি কি বদলে যাবে?
হ্যাঁ। মানুষের আকৃতি-চেহারা একদম পাল্টে যাবে। কারণ সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে বর্তমান প্রযুক্তি ও শিল্প-সভ্যতা পৃথিবীর পরিবেশ দূষণ করছে। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ কমছে। তাপমাত্রা বাড়ছে। বরফ গলছে। দূষণ বাড়ছে। বিশ্ব প্রকৃতি আজ ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন। বিশেষ করে ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন বা সিএফসির আধিক্যে উত্তর গোলার্ধের আকাশের ওজোন স্তর ছিদ্র হয়ে গেছে। যে কারণে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে ঠিকরে আসছে। কে না জানে, অতি বেগুনি রশ্মি দেহে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে এবং ডিএনএকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শুধু কী তাই? ওদিকে পৃথিবীর কক্ষপথে বাড়ছে মহাকাশ বর্জ্যরে পরিমাণও। তাই মহাশূন্যের চৌম্বকীয় প্রভাবে ডিএনএ পরিবর্তন ঘটলে মানুষ বর্তমানের চেয়ে হয়তো অতি বুদ্ধিমান কিংবা নির্বোধ কোনো প্রাণিতে রূপান্তরিত হবে। বিজ্ঞানীরা অবশ্য ডিএনএ রক্ষাকারী এক ধরনের রাসায়নিক আবিষ্কার করেছেন।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে তা কতটুকু কাজে দেবে সেটাই ভেবে দেখার বিষয়। যদি সেই রাসায়নিক কোনো কাজ না করে তবে কী হবে? বিজ্ঞানীরা জানান, এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে মানুষের আকৃতি বা অবয়ব বদলে যেতে বাধ্য। কারণ ডিএনএ ড্যামেজ হলে বিকলাঙ্গ মানুষ জন্ম নেবে। দেখা যাবে মানুষের দুটো কানের জায়গায় রয়েছে একটা বা পাঁচটা কান। হাত-পা বাঁকা। কিংবা দেখা যাবে পুরো শরীরটাই অদ্ভুত। ডিএনএর ক্ষতিগ্রস্ততা এবং ডিএনএ পরিবর্তনের কারণে মানুষের দৈহিক আকার-আকৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। ভিন্ন আঙ্গিকে রূপান্তরিত হবে বর্তমান মানুষ। হাজার হাজার বছর আগেকার আদিম মানবের চেহারার মতো অবস্থায় ফিরে যাবে বর্তমান মানুষ। মানুষ বেঁটে হবে। ক্ষুদ্রাকৃতির এই বামন মানুষরা থাকতে পারবে পাহাড়ের গুহায়। বন-বাঁদাড়ে কিংবা ডালে ডালে ঝুলেও থাকতে পারবে। আজ থেকে এক লাখ বছরের মধ্যে মানুষের বর্তমান আকৃতি একদম লোপ পেয়ে যাবে। বর্তমান ‘হোমোসেপিয়েন্স’ নামের স্বাভাবিক দৃশ্যমান সুন্দর আকৃতির মানব প্রজাতি আর থাকবে না। এভাবে অতি ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে আগামী দিনে বর্তমানের সুন্দর অবয়বের মানুষ।
অন্যগ্রহে আবাস-নিবাস
আগামী দিনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতির কারণে মানবজাতির জন্য বিশ্বের বাইরে অন্য কোথাও আরেকটি আদর্শ আবাসস্থল গড়ার জোরদার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ড. কারি পূর্বাভাস দেন। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করে বলেন, প্রযুক্তিনির্ভরতা ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আগামী দিনে পৃথিবীতে ঘটবে বিরাট জেনেটিক হ্যাংওভার। কমে যাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। জিনগত বিকৃতি বেড়ে যাওয়ায় ক্যান্সারের মতো রোগ বেশি বেশি দেখা দেবে। মানুষ তার সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে হওয়ায় জিনগত অসমতাও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। জিনগত উচ্চ শ্রেণির সদস্যরা হবে চৌকস।
তারা হবে হালকা-পাতলা, সামর্থ্যবান, আকর্ষণীয়, বুদ্ধিমান এবং সৃষ্টিশীল। ছয় থেকে সাত ফুটের মধ্যে থাকবে তাদের উচ্চতা। পাশাপাশি জিনগত নিম্ন শ্রেণির মানুষরা হবে খাটো, মোটা এবং কদাকার। তাদের বোধশক্তিও থাকবে অনেক কম। পরিবেশগত বিপর্যয় ও ভিন্ন ভিন্ন জাতির মধ্যে প্রজননের ফলে অন্য আরেকটা সাধারণ প্রজাতির উদ্ভব হবে। যাদের গায়ের রং হবে কফির মতো। আর এসব কিছু আগামী দিনে মানব প্রজাতিকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেবে। তখনকার মানুষকে সুখী মনে হলেও প্রকৃতির অদ্ভুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনে ত্যক্ত বিরক্তের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছাবে মানুষ।
আগামী দিনের মানব প্রজাতির করুণ অবস্থা ও শ্রেণি বিভাগ সম্পর্কে এইচ জি ওয়েলস অনেক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ড. কারির বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, সেই ভবিষ্যদ্বাণীকেই সত্যি রূপে প্রতিস্থাপিত করল। তাই প্রশ্ন উঠেছে, আমার সব কিছুই যদি বদলে যায়। আগামীর আমি, এখনকার কতটুকু আমি থাকব? আমরা অচিন ও জটিল সময়ে চলে যাচ্ছি না তো? তবু হায়! ভাবতে বড়ই কষ্ট হয়। আজকের মানুষের আগামীর পরিণতি নিশ্চয় হবে বেদনাময়?
শেখ আনোয়ার : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]