ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আমাজনের আগুন ও বাংলাদেশের বন

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
🕐 ৯:৩৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯

আমাজন বন পৃথিবীর আটটি দেশের ওপর অবস্থিত। এটি দক্ষিণ আমেরিকার ৪০ ভাগ এলাকাজুড়ে রয়েছে এবং একে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলা হয়। পৃথিবীর ২০ ভাগ অক্সিজেনের জোগান দেয় এই বন। পৃথিবীর ১০টি প্রাণী প্রজাতির মধ্যে একটি বাস করে আমাজনে। ব্রাজিলের প্রায় ৬০ ভাগ সীমান্তজুড়ে আমাজন বন দেখা যায় বা ব্র্রাজিলের প্রায় ২ দশমিক ১ মিলিয়ন বর্গ মাইলজুড়ে এই বন। এটি কার্বনের আধার আর সবচেয়ে বৃহৎ জীববৈচিত্র্যের বাসভূমি।

বিশ্বের শতকরা ২০ ভাগ অক্সিজেন তৈরি হয় এখানে। আমাজন না থাকা মানে শতকরা এই ২০ ভাগ অক্সিজেন না থাকা। এর ফলে অনেক প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। পৃথিবীতে প্রতি বছর যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ঘটে তার ২ দশমিক ২ বিলিয়ন টন শুষে নেয় এই বন। আমাজনে ১৬ হাজার প্রজাতির ৩৯০ বিলিয়ন গাছ-গাছালি আছে। এখানে ৪৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। এছাড়া আমাজন নদীতে তিন হাজার প্রজাতির মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী আছে।

আমাজন থেকে মানুষসহ পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই উপকৃত হয়। এর গাছগুলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে আর অক্সিজেন ত্যাগ করে। কিন্তু পৃথিবীর ফুসফুস-খ্যাত এই বনের গাছকাটা, মাটি খনন ও কৃষি ব্যবসার জন্য উজাড় হচ্ছে। আমাজনে জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে শুষ্ক আবহাওয়া শুরু হয়। এ সময় আগুন লাগার ঘটনা বেশি ঘটে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চের মতে, এ বছর ৮০ হাজারেরও বেশি বার আগুন লেগেছে। আগের বছরের তুলনায় এটি প্রায় ৮০ ভাগ বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে এই আগুন লাগার মূল কারণ বন উজাড় হয়ে যাওয়া।

সায়েন্স ম্যাগাজিনে পাওলো আর্টেক্সো নামের একজন আবহাওয়াবিদ বলেছেন- আমাজনে যেখানেই নতুন কৃষিভূমি হচ্ছে সেখানেই আগুন লাগছে। বিজ্ঞানীদের মতে আমাজন যদি সাভানার মতো হয়, তাহলে এই ঘন বর্ষণ বনাঞ্চল থাকবে না। তাপমাত্রা বৃদ্ধি শুষ্ক মৌসুমে খরা বৃদ্ধি করে। এতে করে অনেক গাছপালাও মারা যাবে। খরা হলে সেখানকার মাছ, জল আর ডলফিন কমতে থাকবে। স্থানীয় আদিবাসীরা টিকে থাকতে পারবে না।

ব্রাজিলে বনের আগুন দূষণ বাড়িয়েছে। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসহ বিভিন্ন উপাদান মিশে যাচ্ছে। বিপুল পরিমাণ কার্বন যোগ হয়েছে। এ বছর ২২৮ মেগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বাতাসে মিশেছে।

বিবিসির প্রতিবেদন মতে ব্রজিলের উত্তরাঞ্চলে দাবানল বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে রোরাইমারিতে ১৪১ শতাংশ, রোনডোনিয়াতে ১১৫ শতাংশ এবং আমাজোনাসে ৮১ শতাংশ দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। ইনপের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী জুলাই মাসঅব্দি সেখানে ৭২ হাজারেরও বেশি আগুন লেগেছে। ২০১৮ সালে আগুন লাগার ঘটনা ছিল ৪০ হাজারের কম।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের মতে, বন উজাড় হয়ে যাওয়াই অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ। বিবিসি এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে বলছে, ব্রাজিলের তিনটি সংরক্ষিত এলাকা যেখানে নৃগোষ্ঠীর বসবাস, সেখানে সোনা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অবৈধ খনন চলছে।

এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৪ হাজার ৫৬৫ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে বন উজাড় বেশি হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭ লাখ বর্গ কিলোমিটার বন ধ্বংস হয়েছে। এজন্য বন উজাড় হচ্ছে। এক প্রতিবেদন মতে ২০০৪-২০০৫ সাল পর্যন্ত আমাজন বনের প্রায় ১৭ শতাংশ ধ্বংস করা হয়। পরে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে এর ১০০ ভাগের ৮৩ শতাংশ ক্ষতি কমানো হয়। আমাজনে ৩০ লাখ প্রজাতির গাছপালা আর প্রাণী রয়েছে। আদিবাসী বাস করে প্রায় ১০ লাখ।

এ অবস্থায় আমরা পৃথিবীবাসী জনপ্রিয় অভিনেতা লিওনার্দো ডি-ক্যাপ্রিওকে অনুসরণ করতে পারি, যিনি আমাজন সংরক্ষণে বিশাল অঙ্কের অর্থ সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছেন। রেইন ফরেস্ট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক, রেইন ফরেস্ট ট্রাস্ট, আমাজান ওয়াচ অথবা রেইন ফরেস্ট এলায়েন্সের মতো সংগঠন কাজ করছে আমাজন রক্ষায়। আমরা পরিবেশবাদীরা সরকারকে আরও কিছু করার জন্য চাপ দিতে পারি। সম্প্রতি জি-৭ ঘোষণা করেছে তারা কমপক্ষে ২০ মিলিয়ন ইউরো দান করে আমাজন বন সংরক্ষণে সাহায্য করবে। এ ছাড়া কোম্পানিগুলো যেসব পণ্য উৎপাদন করছে তার যেন পরিবেশ সনদ থাকে সেদিকেও সচেতন হতে হবে।

আমাজনে আগুন লাগার অন্যতম যে কারণটি বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করেছেন, সেই বন উজাড় হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশেও হরহামেশা হচ্ছে। দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে তা ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের বন এখন ১৭ ভাগের নিচে। বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশন ও বন বিভাগের ২০০৭ সালের অপ্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে মাত্র ৭ দশমিক ২৯ ভাগ (১ দশমিক ০৮ মিলিয়ন হেক্টর) বনাঞ্চল রয়েছে।

বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ ২৬ লাখ হেক্টর। দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ বনভূমি। বন অধিদফতর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বর্তমানে দেশের মোট আয়তনের মাত্র ১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ এলাকা বৃক্ষ আচ্ছাদিত। বনভূমির ৩৮ দশমিক ৭১ শতাংশ প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন, ৩০ শতাংশ পাহাড়ি বন, ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ সৃজিত ম্যানগ্রোভ বন, শাল বন ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ ও জলাভূমির পরিমাণ ১ দশমিক ৭১ শতাংশ।

এফএওর ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের বনভূমি ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার হেক্টর। ২০১৫ সালে তা কমে হয়েছে ১৪ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম বন পাকিস্তানে। এরপরই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে ১৭টি দেশে কৃষি ও বনভূমি কমেছে। বাংলাদেশ রয়েছে এর শীর্ষে।

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও বনবিভাগ বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা নিয়ে একটি গবেষণা করে। ওই গবেষণা মতে, ২০০০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বনের বাইরে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর এলাকা বেড়েছে। গবেষণায় এও জানা যায়, তিন পার্বত্য জেলায় ৮০ হাজার ৮০০ হেক্টর বন উজাড় হয়েছে।

প্রতিবছর পৃথিবী থেকে এক শতাংশ বন উজাড় হচ্ছে। আর বাংলাদেশে প্রতি বছর ২ হাজার হেক্টর বনভূমি উজাড় হচ্ছে। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৪৫০টি থাকলেও এখন তা ১০০-এর কাছাকাছি নেমে এসেছে।

বাংলাদেশে জ্বালানির প্রয়োজনে গাছ কাটা হয়। পরিবেশ আইন-২০০০ এর বিধি অনুসারে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণে আইনি বাধ্যতা থাকলেও বেদখল হয়ে যাচ্ছে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড় প্রভৃতি জলাশয়। বাংলাদেশের ছোট বড় ২৩০টি নদীর মধ্যে ১৭৫টি মৃতপ্রায়। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮ ক অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’

বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হয়। যে হারে উষ্ণতা বাড়ছে তাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ডুবে যাবে। কমে যাবে কৃষি ভূমি-আবাদস্থল। খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাবে। তা বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়বে। অনেক প্রজাতির প্রাণীরও বিলুপ্তি আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বন ধ্বংস করে কোনো উন্নয়ন হয় না। এতে নিজের পায়ে নিজেদেরই কুড়াল মারা হয়। উন্নয়নকে একমুখী করে এখন ভাবা যাবে না। উন্নয়নের আগে চিন্তা করতে হবে, সেটা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন কিনা। বাংলাদেশে প্রতি বছর বন উজাড়ের হার তিন শতাংশ। এ অবস্থায় জীববৈচিত্র্য, বনভূমি, আদিবাসী, মানুষ, উন্নয়ন সবকিছু আমলে নিয়ে কিভাবে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের পথে এগুনো যায় তা নিয়ে ভাবা উচিত।

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র : গবেষক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper