ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রাঙ্গার ‘দৃশ্যমান নিরপেক্ষ’ মনোভাব

দূরত্ব কমছে না জাপায়

শফিক হাসান
🕐 ১০:৩৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯

দেবর-ভাবির যুদ্ধংদেহি অবস্থান ও স্নায়ুযুদ্ধের আপাত অবসানের পর রংপুর-৩ আসনের উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ‘যোগ্যতা’ অর্জন করেছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ-রওশন এরশাদ দম্পতির একমাত্র পুত্র সাদ এরশাদ। কিন্তু স্থানীয় (রংপুর) ও জাতীয় রাজনীতিতে জাপার যে ভগ্নদশা, দলের ভেতরে-বাইরের নানা অনৈক্য তা ভেদ করে কীভাবে নির্বাচনী পুলসিরাত ডিঙ্গানো যাবে! গত বুধবার মনোনয়নে ইচ্ছুক নয়জনের মধ্যে সাতজনকে নির্বাচনে বৈধতা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রার্থীদের একজন এরশাদের ভাতিজা এবং জনপ্রিয় মুখ আসিফ শাহরিয়ার। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হয়েছেন। অন্যদিকে রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা সাদবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। রয়েছে বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শক্ত প্রার্থীও। এ ত্রিশঙ্কু অবস্থার মধ্যে জাপা যদি গৃহবিবাদ দূর করতে না পারে তাহলে দলটি ভাঙনের দিকেই এগিয়ে যাবে আরেক ধাপ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপ-নির্বাচনে কাক্সিক্ষত ফল পেতে জাপায় দূরত্ব কমানোর বিকল্প নেই। কিন্তু প্রতীয়মান হচ্ছে, এ দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে; বাড়তে বাড়তে তা কোন খাদের কিনারে দাঁড়াবে ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন দলটির নেতাকর্মীরাই।

আগামী ৫ অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য উপ-নির্বাচনের সমীকরণ মোটেই সহজ নয়। দীর্ঘদিন ধরে এ আসনে বারবার নির্বাচিত হয়েছিলেন এরশাদ, তার স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ছোট ভাই জিএম কাদের। জাপার দুর্গ হিসেবে খ্যাত এ আসন আওয়ামী লীগের জন্য বরাবরই ছিল অধরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ এবার চেষ্টা করবে আসনটি দখলে নেওয়ার। অন্যদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি নির্বাচনমুখী হয়েছে। সরকারের সঙ্গে বিবাদ ভুলে দলটি এ উপ-নির্বাচনেও প্রার্থী দিয়েছে। জীবদ্দশায় এরশাদ ম্যাজিকে আসনটি করায়ত্ত ছিল জাপার। কিন্তু নিজেদের ‘ছাওয়াল’ এরশাদ না থাকায় টান কমেছে স্থানীয়দের। তার ওপর দলে গৃহদাহ ও অনাকাক্সিক্ষত বিবাদে পছন্দ করছেন না সাধারণ মানুষ। যে কারণে তারা জাপার প্রতি কিছুটা ক্ষুব্ধ। সাধারণ মানুষের বিষয়টি বাদ রাখলে রংপুরের স্থানীয় রাজনীতিতে জাপায় যে বিরোধ ও ভাঙন দেখা দিয়েছে তাতেও দলটির বিব্রত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

জাপার বৈধ চেয়ারম্যান কে- এরশাদ মনোনীত চেয়ারম্যান জিএম কাদের নাকি দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ! এ বিষয়ে গত সপ্তাহে যে নাটক মঞ্চস্থ হলো শেষপর্যন্ত সেটার যবনিকা টানেন দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। সাদকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার পেছনেও ছিল রাঙ্গার সমর্থন। অন্যদিকে রসিক মেয়র মোস্তফা শুরু থেকেই সাদবিরোধী। স্থানীয়রা মনে করছেন এরশাদপুত্র এ আসনে ‘শিশু’ ও ‘ভাড়াটিয়া’ প্রার্থী। প্রায় অভিন্ন মনোভাব মোস্তফারও। তার সমর্থন ছাড়া নির্বাচনে কী করতে পারবে জাপা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। রংপুরে সাদ তথা রওশনপন্থি রাজনীতির বিরুদ্ধে স্থানীয়দের যে অনাস্থা তাতে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে জাতীয় রাজনীতির একাংশের। মহাসচিবের সরাসরি কোনো পক্ষ অবলম্বন না করাও বিপাকে ফেলেছে সংশ্লিষ্টদের। রাঙ্গার আপাত ‘নিরপেক্ষ নিষ্পৃহ’ ভূমিকায় কোন পক্ষ লাভবান হবে তা নিয়েও রয়েছে জল্পনা-কল্পনা।

রংপুরে জাপার বিদ্রোহী প্রার্থী আসিফ শাহরিয়ারের রয়েছে শক্ত অবস্থান। এরশাদের ভাতিজা হিসেবেও আসিফ সাধারণ মানুষের সমর্থন নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এরশাদের জনপ্রিয়তা ও প্রভাবকে কাজে লাগানোই তার অন্যতম লক্ষ্য। অন্যদিকে সাদ প্রশ্নে আসিফ আগেও ইতিবাচক ছিলেন না। নানাভাবে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন চাচাতো ভাইকে।

ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও বিবদমান জাপায় মধ্যস্থতায় সম্প্রতি দূতিয়ালির ভূমিকা নিয়েছিলেন রাঙ্গা। বর্তমানে তিনি নিরাপদ দূরত্বে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। কোনো পক্ষে না গিয়ে দূর থেকে তার এ নির্বিকার ‘পর্যবেক্ষকের’ ভূমিকায় সন্তুষ্ট হতে পারছেন না অনেকেই। রওশনও এক্ষেত্রে কী করবেন তাও অপ্রকাশ্য।

একদিকে রাঙ্গার সমর্থন অন্যদিকে রসিক মেয়রের আশীর্বাদ- এ দুই-ই পারে সাদ এরশাদকে নির্বাচনী শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে। রাঙ্গা যেমন জাপা ও রংপুরের রাজনীতিতে প্রভাবশালী একজন; মোস্তফাও ইতোমধ্যে নিজের শক্তি ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়ী হওয়া থেকে শুরু করে সর্বশেষ এরশাদের দাফন রংপুরের মাটিতেই করতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। সরকারিভাবে ঢাকায় দাফন প্রচেষ্টা থাকলেও তা রুখে দেন মোস্তফা। এরশাদকে সমাহিত করার সময় লাখো নেতাকর্মীর সমাবেশ ঘটিয়ে মোস্তফা জানান দিয়েছিলেন জাপায় নিজের শক্ত ভিতের বিষয়।

বস্তুত ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নেই জাপা এখন বিভক্ত। দলের ভেতরকার অনৈক্য ও কোন্দলও গোপন নেই। এ অবস্থায় কোন দিকে যাচ্ছে দলটির রাজনীতি, তা কৌতূহলি দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। রংপুর-৩ উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মর্যাদার লড়াই। শক্ত প্রতিপক্ষের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই জিতে আসতে হবে ‘রওশন এরশাদ’কে। যা অনেকটাই কঠিন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ আসনে জাপার জিত কিংবা হারের ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতে দলটির রাজনীতি কোন দিকে যাবে। দলটির যে ইতিহাস শেষ বিচারে তা অন্যের ক্ষমতায় অংশীদার হতে সহায়তাকারীরই! ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির সঙ্গেই কি গাঁটছড়া বাঁধবে জাপা। সেজন্যই কি এ ‘দূরত্ব দূরত্ব খেলা’! যে আসনে এরশাদের বাড়ি, আসনটি পরিচিত জাপার দুর্গ হিসেবেই সেখানে অকৃতকার্য হলে দলটির ফাটল ফের চলে আসতে প্রকাশ্যে। দলের দূরত্ব ও অনৈক্য বাড়বে আরও। সেক্ষেত্রে কী হবে জাপার ভবিষ্যৎ, দলে দূরত্ব বাড়লেও কার সঙ্গে ঘটবে মিত্রতা- আওয়ামী লীগ, বিএনপি নাকি অন্য কেউ! রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ‘ঐতিহ্য’ অনুযায়ী জাপায় ফের ভাঙন দেখা দিতে পারে, তারা পুরনো ‘সংস্কৃতি’তে কেউ এ দল, কেউবা ও দলে ছড়িয়ে-জড়িয়ে পড়বেন!

 
Electronic Paper