ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সত্যের স্বরূপ উন্মোচন করতে চাই

তৌফিকুল ইসলাম
🕐 ১২:৩০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা ড. মাসুদ পথিক চলচ্চিত্র নিয়ে একান্ত ভাবনার কথা বলেছেন তৌফিকুল ইসলামের সঙ্গে

আপনার নির্মাতা হয়ে ওঠার গল্প...
অ্যাকচুয়ালি সিনেমা নির্মাণ আমার খুব ছোটকালের একটা প্যাশন। আমার মনোজগতে এটা ছিল। আমি যখন খুব ছোট, হাইস্কুলে পড়ি ক্লাস সিক্স-সেভেনের দিকে তখন থেকে আমি লেখালেখি করি, পাশাপাশি প্রচুর সিনেমা দেখতাম। হাইস্কুলে নাইন-টেনে যখন পড়ি ঘর থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবসহ সিনেমা দেখতাম। সপ্তাহে দুই/তিনটা সিনেমা দেখতাম। তখন থেকে মনের ভেতরে ছোট্ট বাসনা ছিল যে, সিনেমা নির্মাতা যদি হতে পারতাম।

সিনেমা দেখতে যাওয়া নিয়ে...
পরবর্তীতে যখন ঢাকায় এসে ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলাম, তখন থেকেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাতায়াত আমার। সেখানে সিনেমা দেখা বা তাদের আলোচনা শোনা হতো। সে সময়ে ঢাকা শহরে সিনেমা দেখাটা খুব টাফ ছিল। হলে সব ধরনের সিনেমা অ্যাভেইলেবল ছিল না। কারণ আজকের প্রযুক্তি তখন ছিল না। তখন আমরা সিনেমা দেখতে গ্যেটে ইনস্টিটিউট, আলিয়ঁস ফ্রসেজ, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার, ইরানিয়ান কালচারাল সেন্টার, ব্রিটিশ কাউন্সিলে যেতাম।

সিনেমা দেখার পর ভাবনা...
যেসব ছবি আমরা দেখতে চাই, জীবনমুখী ছবি বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম যেগুলোকে বলি এসবের মেকিংয়ের ওপর আমরা স্টাডি সার্কেল করে পড়াশোনা করতাম বিভিন্ন বই সিলেক্ট করে। আমাদের ১২/১৪ জনের একটা স্টাডি সার্কেল টিম ছিল সিনেমার ওপর, সেখানে আমরা সিনেমার ওপর আলোচনা করতাম। কী কী সিনেমা দেখা যায় বা দেখা উচিত বিভিন্ন রকমের ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফিল্ম মেকার যারা আছেন, তাদের নাম আমি সেখান থেকে জানি। বার্গম্যান, ইন্ডিয়ান ফিল্মমেকার হৃতিক ঘটক, সত্যজিত, জন আব্রাহামসহ অন্যান্য বিশ্বখ্যাত নির্মাতা যারা অ্যাকচুয়ালি খুব স্বাধীন ফিল্ম মেকার ছিলেন, যারা জীবনমুখী ছবি বানিয়েছিলেন। জগদ্বিখ্যাত ছবিগুলো ইন্টারমিডিয়েটেই দেখে ফেলেছিলাম। এসব ছবি দেখে চিন্তা-চেতনা চলে এসেছিল কীভাবে এরকম ফিল্ম বানানো যায়।

নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ ছবিটি নির্মাণের প্রেক্ষিত...
এটা লালন করতে করতে এ পর্যায়ে এসে আমি যখন ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ স্ক্রিপ্ট করার চিন্তা-ভাবনা করি, যেহেতু আমি কবিতা লিখি। আমার তো ১৮টা বই প্রকাশ হয়েছে, আরও তিনটা বই রেডি আছে। ভাবলাম কবিতা যেহেতু লিখি, কবিতা থেকে আমরা গল্প তৈরি করি না কেন? কবিতাকে ভিত্তি করে কেন আমার ফিল্মগুলো তৈরি করি না? সেজন্য আমি যখন স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে গেলাম তখন কবি নির্মলেন্দু গুণের বিখ্যাত কবিতা ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ কবিতাটা আমার খুব সুন্দরভাবে পড়া আছে, সে কবিতাটি আমি নিলাম।

মায়া দ্য লস্ট মাদার...
এরপর আমার সেকেন্ড ছবি ‘মায়া দ্য লস্ট মাদার’, এ ছবিটা মুক্তির প্রতীক্ষায় আছে এখন, এ বছরই রিলিজ হবে। এ ছবিও কবি কামাল চৌধুরীর কবিতা থেকে নেওয়া, পাশাপাশি শিল্পী শাহাবুদ্দিনের পেইন্টিং যিনি ফ্রান্সের নাইট উপাধিপ্রাপ্ত একজন আর্টিস্ট। আমার নেক্সট ছবি যেটা আমি করছি সেগুলোও কবিতা অবলম্বনে। এভাবেই আসলে ফিল্মের চিন্তাটা আমার ভেতরে ঢুকেছে।

গতানুগতিক ধারার বাইরে সিনেমা নির্মাণ করে একজন ফিল্ম মেকার হিসেবে কী আপনি পরিতৃপ্ত?
অ্যাকচুয়ালি আপনি জেনে থাকবেন যে, আমি চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা ফিলোসফির কথা বলে থাকি। ফিলোসফিটির নাম হচ্ছে র-রিয়েলিজম। র ম্যাটারিয়ালিজম থেকে র আসছে। র-রিয়েলিজম একটা ভিন্ন ট্রাকের, মানে একদম ইন্ডিপেন্ডেন্টলি ফিল্ম মেকিং করা যেখানে আর্ট বা নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে আর্ট ফর আর্ট যে থিওরিটা আছে সেটাকে উল্টোভাবে দেখা। মানে শিল্পের জন্য শিল্প নয়, জীবনের জন্য শিল্প, দর্শক-শ্রোতাকে ‘র’ ভাবে ভিজ্যুয়ালি উপস্থাপন করাটা হচ্ছে সিনেমার কাজ।

ফিল্ম মেকার হিসেবে আপনার নিজস্বতা প্রসঙ্গে...
আমি অ্যাকচুয়ালি আমার মতো করে ফিল্ম বানাতে চাই। কারণ আমার ফিল্মগুলো যে লাইন ধরে দর্শক সবাই হলে দেখবে সেটাও না। তবে হ্যাঁ, দেখলে ভালো হতো। দর্শক সবাই দেখলে তো আমি খুশি। কিন্তু আমার ছবিটা অ্যাকচুয়ালি চিন্তার জায়গা থেকে আমি ফ্রি থাকতে চাই এবং আমার সমাজের সত্যের স্বরূপটা আমি সঠিকভাবে উন্মোচন করতে চাই এবং সেটা অনেক ক্ষেত্রে ফিলোসফিক্যালি স্ট্যান্ড করবে। কারণ আমি মনে করি জীবনের যে অন্তর্গত দর্শন আছে সেটাকে শিল্পে নিয়ে আসা বা সিনেমায় নিয়ে এসে ভিজ্যুয়ালি দেখানোটা হচ্ছে একজন স্বাধীন ফিল্ম মেকারের কাজ। আমার জায়গা থেকে আমি সন্তুষ্ট, আর আমার প্রথম ছবি তো এক ধরনের শিক্ষানবিস কাজই বটে। তারপরও আমি হ্যাপি আমার কাজ নিয়ে।

এ আঙ্গিকে নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণকে মূল্যায়ন...
আমি একটু ভিন্ন ধরনের কাজ করার চেষ্টা করি, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ একটা ফিচার ফিল্ম নয়, এটা একটা ডকু ফিচার। মানে অর্ধেক ফিচার এবং অর্ধেক ডকুমেন্টারি। এজন্য অনেক সময় অনেকের প্রত্যাশা অনুযায়ী আমার না-ও মিলতে পারে। কারণ ফিকশন খুঁজতে গেলে অনেকটা ফিকশন পাবেন না। আবার ডকুমেন্টারি পাবেন, আবার ডকুমেন্টারি ফুল খুঁজতে গেলে পাবেন না। এটা একটা আলাদা ধাঁচের ছবি, এটাকে আমি ডকু বায়োপিক ফিচার বলি মানে এখানে ডকুমেন্টারিও আছে আবার বায়ো বলতে এখানে কবি নির্মলেন্দু গুণের কিছুটা জীবনেরও ব্যাপার আছে। আবার দেখা গেছে এখানে কিছুটা ফিচারধর্মিতাও আছে। মানে তিনটা বিষয় আছে এখানে মানে আমার প্রথম ছবিতে।

দ্বিতীয় ছবির ক্ষেত্রে...
দ্বিতীয় ছবির ব্যাপারটা হচ্ছে এটা একটা ডকুমেন্টারি ফিলের ছবি। মানে ডকুমেন্টারি ফিলের মতো করে আমাদের এখানে এ প্রথম আমি যুদ্ধশিশু ও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সিনেমা বানালাম। আমাদের দেশে বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের গল্প নিয়ে সিনেমা হয়নি এখন পর্যন্ত। মায়া দ্য লস্ট মাদার ছবিটা হচ্ছে প্রথম ছবি যেখানে বীরাঙ্গনাদের ও শিশুদের ওপর দৃশ্যটি চিত্রায়িত হয়েছে। এটা কামাল চৌধুরীর একটা কবিতায় আছে এবং পেইন্টিং আছে ‘ওমেন’ নামে প্রিয় শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের যেখানে বীরাঙ্গনার একটা বডি আছে। এটা ইনস্পায়ার্ড করেছে আমাকে। যুদ্ধশিশু নামে কামাল চৌধুরীর একটা কবিতা আছে, এটাও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এভাবে আমি আসলে ভাবছি। আমি আমার মতোই কাজ করতে চাই। এখানে গ্রহণযোগ্যতাটা অনেক পরের ব্যাপার। এটা একটা স্ট্রাগল, এটা একটা সংগ্রাম, এটা একটা লড়াই, এটা ফিলোসফিক্যাল জার্নি। ভিজ্যুয়াল হিসেবে এটা ফিজিক্যাল জার্নি। এখন আমার করে যাওয়াটা হচ্ছে বড় কাজ। ভালো-মন্দটা এটা সময়ই বলে দিবে।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখন উন্মুক্ত। এখানে এখন বিশ্ব মানের চলচ্চিত্রও নির্মাণ হচ্ছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থান নিয়ে আপনার মতামত...
অ্যাকচুয়ালি আমি নিজেও বিশ্বমানের চলচ্চিত্র বানাতে চাই। এবং এটার জন্য নিজেকে তৈরি করছি এবং মনে হয় সময় হয়ে গেছে আমারও। হয়তোবা সামনের ছবিগুলোতেও ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ট্রিটমেন্ট দিবো। যদিও আমাদের বাজেটের একটা সমস্যা আছে। বাজেট সঠিকভাবে পাওয়া যায় না, পাবো না। পাওয়াটা খুব দুষ্কর হয়ে ওঠে। তারপরও আমরা সেটাই করব।
আর আমাকে যদি বাংলাদেশের ফিল্ম নিয়ে মূল্যায়ন করতে বলা হয়, আমি আসলে ঐরকম মূল্যায়ন করার মতো কেউ নই। আমি একজন চলচ্চিত্র কর্মী হিসেবে নির্মাণ করছি এবং নির্মাণ করে যেতে চাই, এবং মূল্যায়ন করাটা এটা হচ্ছে ক্রিয়েটিভদের কাজ। যারা সমালোচনা করবেন কিংবা যারা মূল্যায়ন করবেন অধ্যাপক আছেন তারা করবেন।

চলচ্চিত্র নির্মাণে তরুণদের অংশগ্রহণ...
আমি তরুণদের নিয়ে খুব আশাবাদী, আমি যদি বলতে চাই যারা নতুন আছে আমার বয়সী বা আমার চাইতে কম বয়সী যারা আছেন তারা মনে হয় অনেক বেশি ভালো কাজ করছে এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ করবে। তারা বেশি ছড়িয়ে যাবে। আমি একদম তরুণদের প্রতি খুবই আস্থাশীল। আমার থেকে তরুণ যে আমি তার প্রতি বেশি আস্থাশীল। আমি মনে করি আমাদের চাইতে ভালো করবে সে তরুণটি, যে এখনো শিখছে।

সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

 
Electronic Paper