জীবনবৃত্তান্ত চাওয়া নিয়ে রোমিলা থাপার
সরকার পেশিশক্তি প্রদর্শন করছে
বিদেশ ডেস্ক
🕐 ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৯
ভারতের ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক রোমিলা থাপারের কাছে সম্প্রতি দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) প্রশাসনের পক্ষ থেকে জীবনবৃত্তান্ত চাওয়া হয়। এমেরিটাস অধ্যাপক পদ পুনর্মূল্যায়নের নামে এমন কাণ্ডকে বিদ্ধজনকে অসম্মান করার শামিল হিসেবে মন্তব্য করেছেন।
এ বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ‘এ হিস্টোরি অব ইন্ডিয়া’সহ বহুল আলোচিত বইয়ের এই লেখক। রোমিলা থাপার জেএনইউর পদক্ষেপ, ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা এমন একটি পরিস্থিতিতে, এমন মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছি, যখন আমাদের চিন্তাবিরোধী, বিদ্বজ্জনবিরোধী, অ্যাকাডেমিকবিরোধী হতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
গত ছয় দশক ধরে অধ্যাপনা এবং গবেষণার কাজ করে আসছেন ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার। দেশ বিদেশে একাধিক সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ইতিহাসবিদ হিসেবে তার প্রধান চর্চার বিষয় প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস। দুবার ভারত সরকার পদ্মভূষণে ভূষিত করেছে, কিন্তু দু’বারই তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আর সেই গুণী ব্যক্তির কাছ থেকে এমেরিটাস অধ্যাপনার পদ যাচাইয়ের জন্য জীবনবৃত্তান্ত চাওয়া নিয়ে ক্ষোভ দেখা গেছে দেশটিতে। আপনার জীবনবৃত্তান্ত চাওয়া হয়েছে, কী বলবেন এ নিয়ে? আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি যে, ১৯৭০ সালে ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এমেরিটাস অধ্যাপক নিয়ে যে নিয়ম চলে আসছে, তার শর্তাবলী হঠাৎ বদল করার কথা ভাবা হল কেন। সম্ভবত নতুন সরকার তাদের পেশিশক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে এবং যারা আগে সম্মানিত হয়েছেন, তাদের প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করছে।
আমাকে এখন বলা হচ্ছে, মোট ১২ জনকে, যাদের বয়স ৭৫ পেরিয়েছে, তাদের সবার কাছেই নাকি এই জীবনবৃত্তান্ত চাওয়া হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত তারা কেন নিলেন। দুনিয়ার কোথাও এমেরিটাস অধ্যাপকদের পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না। যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোনো অপরাধ করে থাকেন, যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানহানি হয়েছে, সেক্ষেত্রে তার এমেরিটাস মর্যাদা বাতিল করা যেতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে এ মর্যাদা পুনঃযাচাই কোথাও করা হয় না।
জেএনইউ প্রশাসন তাদের বিবৃতিতে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় চাইলেই নাকি এ বিষয়ে পুনর্মূল্যায়ন করতে পারে এবং এই নিয়ম নাকি এমআইটি এবং হারভার্ডেও রয়েছে, যা একেবারেই ঠিক নয়। কোন বিভাগে কতজন এমেরিটাস থাকবেন এর কোনও কোটা নেই, সব বিভাগে সমাপুপাতে এমিরিটাস থাকবেন, এর পক্ষেও কোনও যুক্তি নেই। জেএনইউ সমাজবিজ্ঞান এবং মানবিকে বেশি ভাল, ফলে এই বিভাগ দুটি থেকে স্বাভাবিকভাবেই বেশি সংখ্যক সম্ভাব্য এমেরিটাস থাকবেন। যেহেতু এটি একটি সম্মানজনক পদ ফলে সংখ্যা কোনও বিষয়ই হতে পারে না। কোনওভাবেই কোনও নতুন এমেরিটাস অধ্যাপক নিয়োগ আটকাচ্ছে না। প্রশাসন সম্ভবত এমেরিটাস অধ্যাপকের ব্যবস্থাটা বুঝতে পারেনি, সাধারণ অধ্যাপনার সঙ্গে ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলেছে।
আসলে যারা স্কুল আর ইউনিভার্সিটি প্রশাসনের পার্থক্য বুঝতে পারেন না, তারা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্ব নেন, তখন এরকমই হয়। আমি কালই ভাবছিলাম, আমার সঙ্গে অন্য যে দুজন ইতিহাসবিদ এমেরিটাস অধ্যাপক হয়েছিলেন, তারা হলেন সর্বপল্লী গোপাল ও বিপান চন্দ্র।
জেএনইউ-এর এমিরিটাস অধ্যাপনার কাজ আমার কাছে অত্যন্ত সমাদরের বিষয় দুটো কারণে। প্রথমত অপেক্ষাকৃত কমবয়সী স্কলার ও সহকর্মীদের সঙ্গে ভাবনার আদান-প্রদান করতে পারি এবং দ্বিতীয়ত যে প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে আমি সহায়তা করেছিলাম তার সান্নিধ্য অনুভব করতে পারি। আমরা কয়েকজন শুরু থেকে এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ছিলাম, বৌদ্ধিকভাবে এবং প্রশাসনিক স্তরেও। এই যোগাযোগটা যাতে থাকে, সারাজীবন তা চেয়ে এসেছি। কিন্তু কেউ এমেরিটাস অধ্যাপক থাকলেন কি না, তার উপরে তার অ্যাকাডেমিক খ্যাতি নির্ভর করে না। এমেরিটাস মর্যাদা মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, যা বিশ্ববিদ্যালয় ও সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক দুপক্ষের ওপর নির্ভরশীল।
আমরা যারা শুরুতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলাম, তাদের একটা আইডিয়া ছিল। আমরা ভাবতাম ভারতীয়রাও এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে পারে, যা বিশ্বমানের এবং মহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত গুণ সেখানে থাকতে পারে। এ গুণগুলোর মধ্যে রয়েছে মুক্ত চিন্তা, মুক্ত মনে প্রশ্ন করা, বিতর্ক, আলোচনা এবং উচ্চমানের অ্যাকাডেমিক সাফল্যও। অত্যন্ত খুশির ব্যাপার, আমরা এগুলো অর্জন করতে পেরেছি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদক্ষেপ এবং সাম্প্রতিক আরও কিছু পদক্ষেপ দেখে এ কথাই মনে হয় যে, প্রশাসন যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে তাহলে জেএনইউ এতদিন ধরে যা করেছে সেগুলোকে প- করাই এর মূল উদ্দেশ্য এবং একে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্তরে নামিয়ে আনাই এসবের লক্ষ্য।