ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ট্রেড ইউনিয়ন করলেই পোশাক শ্রমিক ছাঁটাই

জাফর আহমদ
🕐 ১০:৪৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৯

ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তার স্বীকৃত মাধ্যম হলেও তৈরি পোশাক শিল্পে ঘটছে তার উল্টো ঘটনা। এ শিল্পে শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করার চেষ্টা করছে- এ খবর মালিকপক্ষ জানলেই শ্রমিকদের ছাঁটাই করছে। সংগঠনের নিবন্ধনের জন্য শ্রমিক নেতারা গোপনে কোনোভাবে সরকারি নিবন্ধন অফিসে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করে আবেদন জমা দিলেও নানা অজুহাতে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে আবেদন। গত এক বছরে এভাবে প্রায় ৫০টি আবেদন বাতিল করা হয়েছে। সেইসঙ্গে ছাঁটাই ও কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিককে।

ট্রেড ইউনিয়ন আবেদন বাতিল হওয়া ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে দুর্ভোগ বৃদ্ধির পেছনে আইনের দুর্বলতা, কিছু শ্রমিক নেতার অসততা, মালিকপক্ষের উপর্যুপরি চাপ ও ভীতিপ্রদর্শন এবং শ্রম অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার অনৈতিক অবস্থানের কারণে সাধারণ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হচ্ছে বলে মনে করছেন শ্রমিক নেতারা।

তারা বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন যেখানে শ্রমিক ও শিল্পের সেতু হিসেবে কাজ করার কথা, সেখানে তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক ও মালিকপক্ষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে পরস্পর পরস্পরকে শত্রুভাবাপন্ন করে তুলেছে। এটা তৈরি পোশাক শিল্পের টেকসই বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের মাধ্যমে ১০টি ট্রেড ইউনিয়নের আবেদন জমা পড়েছিল সরকারের নিবন্ধন কর্মপক্ষ ‘রেজিস্টার্ড অব ট্রেড ইউনিয়ন’-এ। ১০টি আবেদনই বাতিল হয়। এসব কারখানা ছিল রাজধানীর উত্তরা এলাকায়। কারখানাগুলো কর্মরত শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক নেতাদের তালিকা করে ছাঁটাই শুরু করে। বিষয়টি শ্রমিকরা জানতে পেরে আন্দোলনের ঘোষণা দিলে ছাঁটাই সাময়িক বন্ধ আছে। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের মাধ্যমে জমা পড়েছিল ১২টি আবেদন।

এসব কারখানার শ্রমিকদের ইতোমধ্যে ছাঁটাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে, এমন দুটির কারখানার ২৮ জন করে শ্রমিক নেতাকে ছাঁটাই করলে শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আশুলিয়ার ফ্যান্টাসি কিংডম এলাকার কারখানা দুটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পোশাক শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে তিনটি ট্রেড ইউনিয়নের আবেদন জমা দিয়েছিল। একটি বাতিল হয়েছে। এসব আবেদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়।

শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। দুয়েকটি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন হলেও পরে তা টিকিয়ে রাখা যায় না। হয় ভালো বেতনে শ্রমিকরা অন্যত্র চলে যায়, না হয় শ্রমিক নেতাদের ওপর জুলুম করে কারখানা থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ কারণে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দেননি বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ও কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি। তার ফেডারেশনের অধীনে ৭ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আছে। কিন্তু এসব কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়নি। তিনি সবার আগে শ্রমিকদের সচেতনতার কাজ করছেন বলে জানান।

সিরাজুল ইসলাম রনির মতে, উদ্যোক্তাদের মাঝে ট্রেড ইউনিয়নভীতি কাজ করে। আর কিছু ফেডারেশনও তৈরি হয়েছে শ্রমিকদের নিয়ে খেলা করার জন্য। তারা ট্রেড ইউনিয়নের জন্য প্রাথমিক কাজ শুরু করে কাগজ-পত্র নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। নিবন্ধনের জন্য নিয়োজিত সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও নানা কথা শোনা যায়। ফলে ট্রেড ইউনিয়ন আর কোনো মতেই শ্রমিকদের দরকষাকষির কাজে ব্যবহার হওয়ার উপায় নেই।

ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের দায়ে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়েছে এবং এসব শ্রমিকের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে মামলার কার্যক্রম শুরু করেছে জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক জোট। ফেডারেশনটির সভাপতি মোতালেব হোসেন শহীদ জানান, তাদের সংগঠনের মাধ্যমে গাজীপুর শিল্প এলাকার ছয়টি কারখানার শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দিয়েছিল। এর মধ্যে দুটি কারখানায় আবেদন ইতোমধ্যে বাতিল হয়েছে। এসব কারখানার প্রস্তাবিত ইউনিয়নের নেতাদের ছাঁটাই করা হয়েছে। বাকিগুলোর ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে জানা যাবে আগামী মাসে।

এ ব্যাপারে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কার্যকরি সভাপতি কাজী রুহুল আমিন বলেন, সরকার আর মালিক মিলে শ্রমিকদের স্বার্থের বিরুদ্ধে নেমেছে। ট্রেড ইউনিয়নের জন্য আবেদন পত্র জমা দিলেই কিছু দালাল ও অনুগত শ্রমিক সংগঠনকে বেছে বেছে নিবন্ধন দেওয়া হয়। আর বাকিগুলো বাতিল করা হয়। তারই অংশ হিসেবে আমাদের ১০টি আবেদন বাতিল করেছে। এটা কোনোভাবেই শিল্পের জন্য সহায়ক নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বিষয়টি নিয়ে বিজিএমইএ-এর সিনিয়র সভাপতি ফয়সাল সামাদ খোলা কাগজকে বলেন, ‘ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের সঙ্গে ছাঁটাইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। তৈরি পোশাক শিল্পে ছাঁটাই বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে- এ জন্য তাদের আইনানুগ পাওনাও পরিশোধ করা হয়। ট্রেড ইউনিয়ন করতে চাইলে ছাঁটাই করা হয়- এমন অভিযোগের ভিত্তি নেই। ট্রেড ইউনিয়ন করা শ্রমিকদের আইনানুগ অধিকার আর নিবন্ধন দিয়ে থাকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই।’

 
Electronic Paper