ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

একজন বন্ড ও বাস্তবতা

প্রসেনজিৎ হালদার
🕐 ১০:১৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৯

আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া গেলেও রাতারাতি নয়ন বন্ড হওয়া যায় না। মাত্র একটি ঘটনাই যে দেশের প্রেক্ষাপট বদলে দিতে পারে, তা বরগুনার প্রকাশ্য কোপাকুপি এবং তা প্রশাসনের নজরদারিতে আসলেই বোঝা যায়। ক্ষমতার দাপটে এতটাই বুদ হয়েছিল নয়ন, সে বুঝতে পারেনি রিফাত শরিফকে করা আঘাতের ক্ষত তার গায়েও পড়বে। আলোচিত কিংবা রোমহর্ষক যাই বলি না কেন, দিনে-দুপুরে রামদা বা হাঁসোয়া দিয়ে কোপানো এবং রাতের আঁধারে বন্দুকযুদ্ধ- দুটোই একটি অপরটির সঙ্গে জড়িত। আর সবচেয়ে দুঃখজনক হলো- এ দুটো বিষয়ের যোগসূত্র বা মিল।

প্রথমত, বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতা, আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি এবং মাদক। সঙ্গে অবাধ ক্ষমতা। মাদকের সাম্রাজ্য এবং মেয়ে মানুষের ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছে দুই বন্ধুর প্রাণ। ক্ষমতা আর লোভ বিষে রূপান্তরিত হয়ে তা গায়ে ছড়িয়েছে। তারই কষাঘাতে হত্যার শিকার হয়েছে রিফাত শরিফ।

দ্বিতীয়ত, কথিত বন্দুকযুদ্ধের তকমা বা ক্ষমতাবলে পরলোকে গেছে নয়ন। বিষয়টি খুব পরিষ্কার ছিল- এতগুলো লোকের সামনে কোপাকুপির ঘটনায় নিহত রিফাত শরীফ এবং যারা কাজ করেছেন অর্থাৎ বন্ড বাহিনী উভয়ই অর্থবিত্ত এবং প্রভাবশালী। কান টানলে যেমন মাথা আসে কিংবা শরীরের যে কোনো স্থানে আঘাত লাগলে তা যেমন মস্তিষ্ক অনুধাবন করে, নয়নের মৃত্যুও এ জাতীয় কারণেই হয়েছে।

অন্তুত, নয়ন মারা গেলে এ ঘটনার মাথা সামনে আসবে না। অথচ, মৃত্যুদণ্ড বহুল প্রত্যাশিত হলেও মৌখিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ নিহত রিফাত-নয়ন, রাজনীতিবিদসহ প্রশাসন নিজেও।

তবে, দেশ যেহেতু সরকার এবং প্রশাসনের দুই হাতের ওপর নির্ভর করে চলে, তাই প্রকৃতপক্ষেই বরগুনার ঘটনাটির সঙ্গে দু’পক্ষেরই প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। বছরের পর বছর খাইয়ে-পরিয়ে, ক্ষমতা দিয়ে, মগজ ধোলাই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বন্ডদের। আর তৈরি হয়ে বেপরোয়া হওয়া থামাতেও একদিন লাগেনি।

আদর দিয়ে মাথায় উঠানোর পর বাদর যেমন চুল টানে এবং আছাড় খায়। ঠিক তেমন পরিণতিই হলো বন্ড বাহিনীর। যারা মাথায় উঠিয়ে নাচালেন, তারাই আবার ঝরিয়ে দিলেন। এখন এর থেকে বড় কোনো ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত কারও পক্ষেই বরগুনার দৃশ্য ভোলা সম্ভব নয়। বড় ঘটনা না হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ভিড়ে এক সময় আড়াল হবে বন্ডদের কাহিনী।

সে না হলেও ঘটনা পেছনে পড়তে পড়তে এক সময় তা আড়াল হয়ে যাবে। তার আগে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে এ ঘটনা নিয়ে। ইতোমধ্যে হয়েও গেছে। মানুষের মস্তিষ্ক এত দুর্বল নয় যে, রাতারাতি সে দৃশ্য ভুলে যাবে। সিসিটিভি ফুটেজের ভিডিও এবং আগের পরের ঘটনাগুলো শুধু ঘটনা ছিল না বরং এর নেপথ্যেও অনেক কিছু ছিল। এগুলোর একেকটি কাহিনী পরস্পরের সঙ্গে গাঁথা। ঠিক যেমন আছে পুরনো পুরাণ কিংবা ইতিহাস উপন্যাসে।

এখানেও ব্যতিক্রম ঘটেনি এবং ভবিষ্যতেও এ জাতীয় ঘটনা ঘটবে। আর যদি আবারও নয়ন-রিফাত-মিন্নি জাতীয় কোনো ঘটনা ঘটে, তাও একই রকম হবে।

সবাই বোঝে কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। অথচ, বেশিরভাগ সময় করা কিছু থাকে না। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে অনেক নয়ন রাস্তায় রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর ভুক্তভোগীদের বিপরীতমুখী সম্মেলন জন্ম দিচ্ছে প্রশ্নের। তবে, বরগুনার ঘটনায় হওয়া মামলার বর্তমান প্রধান আসামিসহ যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা যে খুব সহজে আইনের বাইরে যেতে পারছে না, তা খুব পরিষ্কার। কিন্তু, মিন্নিও যে দুধে ধোয়া তুলসি পাতা ছিল না, তা সবাই বুঝতে পারছে। তবুও ক্ষতির বিবেচনা করলে মিন্নির স্থানই সবার প্রথমে। অথচ, অবশেষে প্রধান সাক্ষীই হলো আসামি।

রাজনীতির ময়দানে প্রতিটি ঘটনার কড়ায় গণ্ডায় হিসাব হয়। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নয়ন বন্ডরাও খুব কাজে আসে। এর মধ্যে হাতে গোনা দু’একজন টিকে থাকে। বাকিরা ঝরে যায়। বন্ড বেঁচে থাকলে এ ঘটনা যে কতটা ঘোলাটে হতো, তা এখন প্রশ্নের বাইরে। বরং খুন, মাদক এবং শত্রুতাই এখন আলোচ্য বিষয় হোক।

পরিষ্কার যে, মাদকের সঙ্গেই যুক্ত ছিল নয়ন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। শুধু বরগুনার প্রয়াত নয়ন নয়, মাদকের সঙ্গে যুক্ত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের তৃণমূলের কর্মীরা। মামলা, তদন্ত এবং ঘনিষ্ঠজনের বিবৃতিতে বরগুনার ঘটনাটিতে মাদকের বিষয়টি স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার। আর আঁতাতের বিষয়টিও সবার গোচরেই আছে। মাদক ব্যবসা এবং এর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থও ক্ষমতার বড় একটি অংশ। অর্থাৎ, বরগুনার যে গ্রুপটি রাজত্ব করছিল তাদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধাভোগীও কম ছিল না। কিন্তু তা আজ অন্ধকারের সঙ্গী হয়েছে।

এখন বিচার ও শাস্তির অপেক্ষায় আছে বন্ডবাহিনী-মিন্নি এবং জড়িত সন্দেহভাজনরা। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে কোনো মহল্লাই মাদকের বাইরে নেই। দীর্ঘদিনের জের, প্রতিহিংসা, ক্ষমতা এবং ঘটনাবলীর প্রতিক্রিয়ায় তছনছ হয়েছে আমাদের মতোই রক্তমাংসের মানুষগুলো। নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রিফাত শরীফ যে কোপ সহ্য করতে পারেনি, সে ক্ষতের প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই দগ্ধ হবে দীর্ঘদিন। আর সন্দেহাতীতভাবেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে নেপথ্যে অন্ধকারের ক্যাডাররা। তাদের নিয়ে টু শব্দটি করার ক্ষমতা নেই সাধারণের।

এমন পরিস্থিতি দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে। এভাবে চলতে চলতে আবার দেখা মিলবে নয়ন বন্ডদের মতো সীমা ছাড়ানো রক্তমাংসের আরও যুবককে। সে আগে পরে ক্ষতের জ্বালা বুঝবে না। নিজেও মারা পড়বে ক্ষতের শিকার হয়ে। আশা করি এমনটি যেন না হয়।

কোটি কোটি মানুষ চিনবে একটি মাত্র নয়ন বন্ডকে, তাকে ধিক্কার দেবে। এ কেমন কথা! সবারই মনে রাখা উচিত, মায়ের পেট থেকে সে নয়ন বন্ড হয়ে পৃথিবীতে জন্মলাভ করেনি। নিশ্চয়ই এর পেছনে অনেকেই জড়িত।

পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মানবিক দায়বদ্ধতার ঘাটতিতেই পাখা গজিয়েছিল নয়নের। কিন্তু তা টেকেনি। এভাবেই ঝরেছে, ঝরছে এবং ঝরবে বাড়ন্তরা। সীমা অতিক্রম করলেই সব শূন্যে নেমে যাবে। মুখ্য দায়িত্বে যারা রয়েছেন তারা যে শক্ত হাতে হাল ধরে আছেন তাও নয়। নীতি-নৈতিকতা, শিষ্টাচার, বোধবুদ্ধি নির্দিষ্ট মাত্রায় গড়ে উঠছে না সমাজের তরুণ-যুবকদের মধ্যে। সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হচ্ছে না কোনোভাবেই।

নয়ন, রিফাত শরীফ, রিফাত ফরাজী, মিন্নিসহ আরও যারা এবং কবর ও আদালতের সম্মুখীন হচ্ছেন তাদের সময় ছিল অন্তত নিজের জন্য অথবা দেশকে এগিয়ে নেওয়া প্রত্যয়ে লেখাপড়া, সৃষ্টিশীল কর্ম, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মনোনিবেশ করা। কিন্তু এ কি হলো! কার দোষ, আর কার দোষ নেই, সে বিচারের জন্য আদালত-বিচারক আছেন। কিন্তু, অপরাধ করার আগেই যদি তাদের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে জ্ঞান থাকত তাহলে শত্রুতা, মাদক, ক্ষমতার লোভ, খুন ইত্যাদি তাদের গ্রাস করত না। এখানে তাদের কৃতকর্মের জন্য শুধু তারা নিজেরাই দায়ী নয়। পৃথিবীতে আসার পর তাদের বেড়ে ওঠা এবং সমাজের লোকজনের সঙ্গে মেশাই তাদের কাল হয়েছে।

অর্থাৎ, সঠিক পথে তারা পরিচালিত হয়নি বা তাদের উচিত পথ দেখানো হয়নি। তাদের দোষের সঙ্গে সঙ্গে সমাজেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে। বরগুনায় ঘটনার আগে পরে যারা তাদের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদেরই প্রথম ধাপে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। নয়ন, মিন্নি, রিফাতরাও একই সমাজের অংশ। ভালো কাজ কিংবা অপরাধের ফলও ভোগ করে সমাজ। একটি সুস্থ ধারার সমাজে অপরাধ প্রবণতা কম দেখা যায়। কিন্তু, বরগুনার পরিস্থিতি এখন প্রদীপের নিচের অংশ।

সেখানে আলো জ্বালাতে এগিয়ে আসতে হবে সমাজকে, পরিবারকে, সৃষ্টিশীল মানুষকে। অপরাধের জন্য শাস্তি পেতেই হবে। কিন্তু, ভুল হলে তা থেকে নিস্তার মিলতে পারে। বরগুনার ঘটনায় জড়িতদের ভালো কিছু করার সম্ভাবনা এখন নিভু নিভু। তাদের জন্য বস্তাপঁচা ঘৃণা, সর্বোচ্চ শাস্তি এবং অবহেলাই সম্বল। এই একজন নয়ন বন্ড এবং আমাদের সমাজের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। এ ধারায় যুক্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্মও। ভালো কাজের মূল্যায়ন সব সময়ই হবে। আর খারাপ কাজের জন্য থাকছে শাস্তি-দণ্ড-অবহেলা-ধিক্কার।

প্রসেনজিৎ হালদার : সাংবাদিক, কলামিস্ট
[email protected]

 

 
Electronic Paper