শাস্তির চেয়ে পুনর্বাসন আগে
এম কবীর
🕐 ১১:১৭ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৯
বাহারি কাটিংয়ের চুলে বিচিত্র রং, হঠাৎ করেই সড়ক দিয়ে বিকট শব্দে ও বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকল চালিয়ে ছুটে যাওয়া- উঠতিবয়সী কিশোরদের এ রকম হইহুল্লোড় রাজধানী ঢাকাসহ শহরগুলোর খুব স্বাভাবিক দৃশ্য। সাদা চোখে দেখে মনে হতে পারে বয়সজনিত চঞ্চলতার কারণেই তাদের এই বেয়াড়াপনা। কিন্তু বাস্তবে এসব কিশোর গ্যাং-গ্রুপ গঠন করে বিপথগামী হচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে খুনোখুনিসহ নানা অপরাধে। সম্প্রতি দেশজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে র্যাব-পুলিশ। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ও দারিদ্র্য এসব কিশোরের অপরাধী হয়ে ওঠার মূল কারণ। তাই শাস্তির চেয়ে যে কারণে তারা অপরাধী হয়ে উঠছে সেটা বের করে পুনঃবাসন আগে দরকার।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এ বছরই গ্রেফতার করা হয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক সদস্যকে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত র্যাবের হাতেই গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে রয়েছে ১৯০ জন কিশোর। বয়সের কারণে কিশোর সংশোধনীতে পাঠানো হয়েছে অনেককে। এ বয়সের কিশোরদের বিভিন্ন অসামাজিক কাজ ও নানা অপকর্মে জড়িত হয়ে বিপথে যাওয়াকে দেশ ও সমাজের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে অপরাধীর সংখ্যা বেড়ে যায় নানান কারণে। তার মধ্যে অভাব-অনটন একটি। কিন্তু কিশোরদের অধিকাংই বিপথে যাচ্ছে তাদের পারিবারিক একটি নেগেটিভ ভাবনা থেকেই। তা ছাড়া সমাজের ছিন্নমূল স্তরের কিছু সন্তানও বিপথগামী হচ্ছে অভাব-অনটনে সমাজের কোনো এক শ্রেণির মানুষের ছত্রছায়ায়। আবার অনেকেই নিজেদের চাহিদাকে মেটাতে গিয়ে পরিবারের কথা অমান্য করে নানা ধরনের ক্রাইমের সঙ্গে জড়াচ্ছে। আবার কেউ কেউ কৌতূহলবশত বন্ধুদের সময় দিতে গিয়ে বিপদগামী হচ্ছে। তবে পারিবারিক ও সামাজিক বলয়ের মাঝে সৃষ্ট কিশোর গ্যাং বড় অপরাধী চক্রের নজরে আসলে আর ফিরে আসার কোনো সুযোগ থাকবে না-যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অশনি সংকেত বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন দেয়াল লেখনীর মাধ্যমে গ্যাং গ্রুপের সূচনা হয়। এরপর বিভিন্ন মহল্লায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার, মাদক সেবন, ঝুঁকিপূর্ণ মোটারবাইক চালানো, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদকে জড়িয়ে বিপথে চলে যায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নগরীর কয়েকটি এলাকায় কিশোর গ্যাংদের দ্বারা বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসেছে। তারই ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত বিভিন্ন নামে-বেনামে প্রায় অর্ধশতাধিক গ্যাংয়ের উগ্র কর্মকাণ্ডের হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসেছে। তারই ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত বিভিন্ন নামে-বেনামে প্রায় অর্ধশতাধিক গ্যাংয়ের উগ্র কর্মকা-ের সন্ধান পেয়েছে তারা। ওই সব গ্যাং সদস্যদের নজরদারির মধ্যে রেখে গ্রেফতার করে সংশোধনী কারাগারেও পাঠানো হচ্ছে।
কিশোর গ্যাং নিয়ে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লে. কর্নেল ইমরানুল হাসান জানান, কিশোররা অপরাধের সঙ্গে জড়াবে এটা কখনো সভ্যসমাজের কাজ হতে পারে না। ভবিষ্যৎ দেশ গড়ার কারিগররা যদি অপরাধে জড়িয়ে যায় সেটা দেশ ও জাতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। তাই যে সব এলাকায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে তাদের বিষয়ে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি কিছু সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে অপরাধ অপরাধই। তাই বয়স বিবেচনায় নয় অপরাধ বিবেচনায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের গ্রেফতারের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। যারা কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
ঢাকা মহানগরের ডিবির উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান জানান, যারা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত বর্তমানে তাদের বেশির ভাগই পারিবারিকভাবে অসচ্ছল পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। অনেকেই আবার ভালো পরিবারে বড় হলেও পরিবারের নানান সমস্যার শিকার হয়ে বিপথে গিয়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে। তাই যারাই এই কিশোর গ্যাং কালচারের নামে বখাটেপনা করছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। তাদের পরিবারের সদস্যদের ডেকে এনে নিয়ে আইনের প্রক্রিয়ার ভিতর থেকেই বোঝানো হচ্ছে।
গ্যাং কালচার নিয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রধান ড. জিয়া রহমান বলেন, আমাদের সমাজে গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং কালচার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে কাজ করছে সেটা কিছু সময়ের জন্য ভালো ফল দিতে পারে। কিন্তু র্যাব-পুলিশের ভয়ে গ্যাং কালচার বন্ধ হবে এটা ভাবার অবকাশ নেই। সাময়িক বন্ধ হলেও আবারও সংগঠিত হবে এটাই গ্যাং কালচারের আদর্শ। সমাজের ডাইমেনশন চেইঞ্জ হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই কিশোররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। দারিদ্র্য, হতাশা, স্কুল ড্রপ আউট, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে অনেকে কিশোর গ্যাং কালচারে জড়িত হচ্ছে। তারা কেন এই কালচারে জড়িত হচ্ছে সেগুলো শনাক্ত করে এর সমাধান বের করতে পারলে এসব কিশোরকে রক্ষা করা সম্ভব। এই কাজে তাদের পরিবারকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে।