ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সঙ্গী অসুখ-বিসুখ

চা পাড়া ঘুরে এসে-৩

ছাইফুল ইসলাম মাছুম
🕐 ১০:৩১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১৯

স্বাস্থ্য টিপস পড়ে আমরা খোঁজ রাখি, কোনো চা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী। অথচ আমরা কেউই খবর রাখি না, চা পাড়ার নায়করা কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে চা উৎপাদন করেন। মৌলভীবাজার জেলায় বেশকিছু চা বাগান ঘুরে চা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রায় অপুষ্টি, রক্তশূন্যতা, জ্বর, ম্যালেরিয়া, আমাশয়, ডায়রিয়াসহ নানা অসুখ-বিসুখে ভোগেন। এ সব রোগ থেকে মুক্তির জন্য ভালো চিকিৎসা সেবা পান না।

চা শ্রমিকদের অসুস্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, প্রথমত কম মজুরির কারণে এসব শ্রমিকরা অপুষ্টিকর খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হন। দ্বিতীয়ত অধিকাংশ শ্রমিক পল্লীতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই। ফলে বেশিরভাগ সময় খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করেন। এ কারণে চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সারা বছর রোগ লেগেই থাকে। কমলগঞ্জ ফুলবাড়ী চা বাগানের শ্রমিক তেজ কুমারের ছেলে সূর্য কুমার খোলা কাগজকে জানান, পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকায় ঘরের পাশে খোলা জায়গায়, খালে মলমূত্র ত্যাগ করেন। টয়লেট না থাকায় নারী চা শ্রমিকরা বেশি সমস্যায় ভুগেন বলে জানান সূর্য কুমার।

শ্রীমঙ্গলের ফুলছড়া চা বাগানের নারী শ্রমিক ভারতী বাগচী (৬০) বলেন, তাদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। দিনের বেলায় টয়লেট করতে গিয়ে অনেক সময় লজ্জায় পড়তে হয়।

স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম অগ্রসর দেশ হওয়া সত্ত্বেও চা বাগানের চিত্র একেবারেই উল্টো। এখানে শ্রমিকদের ৯৮ ভাগ স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ পান না। অথচ শ্রমিকদের শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিত করার কথা চা বাগান মালিকদের। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৫৯ ধারায় বলা হয়েছে, মালিক পক্ষ নিজ খরচে শ্রমিকদের জন্য শৌচাগার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী খোলা কাগজকে বলেন, অধিকাংশ শ্রমিকের বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যবস্থা নেই। আইনে শ্রমিকদের উপযুক্ত চিকিৎসার কথা বলা হলেও, চিকিৎসা সেবা নামমাত্র চালু আছে, যা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়।

চা শ্রমিকদের অসুখ-বিসুখের জন্য স্বাস্থ্য সচেতনতাকে দায়ী করেছেন ফুলবাড়ী চা বাগানের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা সহকারী বিপ্লব দেব। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের তো সমস্যা আছেই। তার ওপর শ্রমিকরা পান, চুন, তামাক, মদ খাচ্ছেন নিয়মিত। ফলে সহজে তাদের রোগ ছাড়ে না।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের হিসাবে, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়- এই সাত জেলার প্রায় ১৬৪টি চা বাগানে পাঁচ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই নারী। চা শ্রমিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের চা শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। চা শ্রমিকদের ৬৩ শতাংশই রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বেশিরভাগ চা বাগানে শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নেই। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করলেও ঝড়-বৃষ্টিতে আশ্রয় নেওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই কর্মক্ষেত্রের পাশে। বিশ্রামও সেভাবে পান না শ্রমিকরা। স্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব টের পান ৭৫ শতাংশের বেশি চা শ্রমিক। ৮৪ শতাংশ চা শ্রমিক ভোগেন মাথাব্যথায়। মাংসপেশির ব্যথা নিয়েও কাজ করেন ৭৪ শতাংশ শ্রমিক। আর পিঠের ব্যথায় আক্রান্ত চা শ্রমিকদের ৭২ শতাংশ। এসব রোগে ভুগলেও চা শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসা সুবিধা বেশ দুর্বল।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা বোর্ডের সচিব কুল প্রদীপ চাকমা খোলা কাগজকে বলেন, চা বাগান মালিকরা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা করতে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট করে দেওয়ার কথা রয়েছে। কোনো চা বাগানে স্যানিটেশন ব্যবস্থা কেমন আছে আমরা খোঁজ নেব। তিনি বলেন, আগামী অক্টোবরে বোর্ডের মিটিংয়ে চা শ্রমিকদের স্যানিটেশন ব্যবস্থার কথা তুলব। সেখানে মালিক, শ্রমিক প্রতিনিধিসহ সব পক্ষের প্রতিনিধি থাকবে।

 
Electronic Paper