বেহিসেবী নজরুলের হিসেবের খাতা
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য
🕐 ৬:২৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩০, ২০১৯
শ্রাদ্ধবাসরের শ্রদ্ধানিবেদনে অরুচি ছিল তার। ঝাঁকড়া চুলের এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকেন রাতে গরাদ আঁকড়ে জানালায়। সবাই বলে তার নাকি আজকাল হুঁশ নেই। ছোট ছেলে মারা গিয়েছে সদ্য। তিনি কিন্তু মৃত ছেলের ছবিতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন যত্নে। পুত্রবধূকে সাদা শাড়িতে দেখে চোখ থেকে নেমে আসছে জলের ধারা। ছেলেটি কাজী অনিরুদ্ধ, বাবার নাম কাজী নজরুল ইসলাম, মৃত্যুর কিছু বছর আগেও জীবন যাকে রেয়াত করেনি দুঃখ দিতে। অভাব আর দারিদ্র্য ছিল সহাবস্থানে। তবু মেজাজ আর মনন ছিল নবাবী রোশনাইয়ে উজ্জ্বল।
নীল খিলানে উল্কা ছোটার মতো ক্ষিপ্র গতি ছিল তার পছন্দের। গাড়ি চড়ে ঘুরতে যেতে ভালোবাসতেন খুব। বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্র একদিন আর্থিক অবস্থা দেখে বলেছিলেন, ‘ট্রামে যাতায়াত করো না কেন? ট্যাক্সিতে তো খরচ বেশি।’ হেসে বলেছিলেন, ‘ট্রামে ওই ঢিকিরঢিকির করে চললে মনে হয় জীবন বড্ড ধীরস্থির হয়ে যাচ্ছে। গতিই আমাকে কষ্টযন্ত্রণা ভুলিয়ে দেয়।’ সেই গতির নেশায় ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ক্রাইসলার গাড়িও কিনেছিলেন, অথচ বাকি লোন শোধ করার ক্ষমতা ছিল না। এদিকে আসা-যাওয়ার পথে ভিক্ষে দিতেন নিয়মিত। হঠাৎ দেখলেন একদিন এক ভিখিরি মারা গেছে। চাঁদা তুলে তার সৎকারের ব্যবস্থা করে এলেন নিজেই।
বল্গাহীন আবেগ ছিল বলেই প্রেমে পড়েছেন, আঘাতও পেয়েছেন। আবার প্রেমিকা নার্গিসকে নিজেই একদিন প্রত্যাখ্যান করেছেন বিয়ের পিঁড়িতে। কারণ তিনি যাকে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন ভালোবাসায়, তার মামা চেয়েছিল নজরুলকে ঘরজামাই করে তার লেখা বেচে টাকা রোজগার করতে। নার্গিসও তার কোনো প্রতিবাদ করেনি যা নজরুলকে ব্যথিত করেছিল। পরবর্তীতে ভালোবাসার আশ্রয় পেয়েছেন এক হিন্দু মেয়ের কাছে। তাকেই বিয়ে করেছেন। সমাজ সংসারে ঢিঢি পড়ে গিয়েছে। তবুও অবশ্য বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন পাত্রীর বিধবা মা। এই ছিল নজরুল আর আশালতা তথা প্রমীলার বিয়ের প্রেক্ষাপট।
বিবাহিত জীবনে মুসলিম এবং হিন্দু নিয়ম দুইই নিজের ইচ্ছেমতো পালন করেছেন প্রমীলা। ধর্মান্তরিত যাতে না হতে হয়, তাই বিশেষ বিবাহ আইন মেনে বিয়ে হয়েছিল তাদের।
সেই সময়টা তখন দেহের নিম্নাঙ্গের পক্ষাঘাতে শয্যা নিয়েছেন প্রমীলা। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য নিজের গ্রামাফোন রেকর্ড আর সাহিত্যসম্পদের রয়্যালিটি বন্ধক রেখেছেন নজরুল। তারও আস্তে আস্তে বোধবুদ্ধি থমকে আসছে। প্রিয়তমা প্রমীলা আর তার ভালোবাসা কিন্তু তবুও ছিল বজ্রশিখার মশালের মতো উজ্জ্বল। দুজনে দুটো পাশাপাশি চৌকিতে শুতেন। শুয়ে শুয়েই সারাদিন স্বামীর দিকে নজর রাখতেন প্রমীলা। পাশ ফিরতে গেলে যার লোকের সাহায্য দরকার হতো তিনিই খাটের সঙ্গে লাগানো বটি দিয়ে সবজি কাটতেন। সংসারের হালচাল জানতেন রীতিমতো।
একবার পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী খেতে দিয়েছেন নজরুলকে। কিন্তু কিছুতেই তিনি বসছেন না খেতে। সবাই অবাক। অবশেষে প্রমীলা বললেন, কবির প্রিয় আসনটি পেতে দেওয়া হয়নি। সেইটি পেতে দিতেই হাজির নজরুল। এ হেন অর্ধাঙ্গিনীর কবরের পাশেই নজরুলের কবরের মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছিল তারও সমাধি। মৃত্যুতেও তাদের বিচ্ছেদ হয়নি।
মহাবিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর ধূমকেতুর তেজ ছিল যার, বৃদ্ধ বয়েসে হয়ে গিয়েছিলেন একদম শিশুর মতো। যা পেতেন গুঁজে দিতেন বালিশের তলায়। একবার ছেলে অনিরুদ্ধর সিগারেটের জ্বলন্ত প্রান্তভাগ এনে রেখে দিয়েছেন অমনি। হঠাৎ ধোঁয়া দেখে সকলে অবাক। তল্লাশি করে জানা গেল এই কাণ্ড! সে এক চরম বিপদ থেকে কোনোমতে রক্ষে তারপর।
পুত্রের অকালমৃত্যুতে জর্জরিত হয়ে তন্ত্রসাধনা অবদি করেছেন একবার তাকে দেখবেন বলে। সেই তিনিই আবার এক রাত্রিতে লিখে ফেলেছেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। পেনের নিব বারবার কালিতে ডুবিয়ে নিতে গেলে যদি মনঃসংযোগ ব্যাহত হয়? তাই অত বড় কবিতাটি পেন্সিলে লিখেছেন পুরোটাই! যেখানে সেখানে লিখে রাখতেন অনেক কিছু। হারিয়ে গিয়েছে অযত্নে সাড়ে তিন হাজারের বেশি গান। বলতেন, ‘সমুদ্র থেকে এক ঘটি জল তুলে নিলে কি সমুদ্র শুকিয়ে যায়?’ একবার স্ত্রীর জন্য বন্ধু নৃপেন্দ্রকৃষ্ণর থেকে ধার আনতে যাচ্ছেন টাকা। পথে বসেই হ্যান্ডবিলে লিখে ফেললেন গান, ‘বাগিচায় বুলবুল তুই দিসনে আজি দোল’। তারপর সেই নোটেশন টাকার বদলে গুঁজে দিলেন বন্ধুর হাতে।
আর একটি মজার ঘটনা! ক্ল্যাসিকাল গাইয়ে জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী ‘অল্প লইয়া থাকি’ গাইলেন শখ করে। রবীন্দ্রপ্রেমীরা গায়কীর অজুহাতে অসন্তোষ প্রকাশ করল। মনমরা শিল্পীর জন্য নজরুল সেই ধাঁচেই লিখে দিলেন একটি গান! সেইটে গেয়ে গায়কের আত্মা তৃপ্তি পেল। অন্যের জন্য এমনই দরদ নিয়ে জন্মেছিলেন নজরুল ইসলাম।
রবিঠাকুরের সাথে তার সম্পর্ক ছিল স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো। আবার শ্রদ্ধা আর অভিমান দুইই ছিল তাতে। সেন্ট্রাল জেলে অনশন করছেন তখন নজরুল। কবিগুরু শিলংয়ে। অনশন ভাঙার জন্য অনুরোধে টেলিগ্রাম করে নজরুলকে লিখলেন, আমাদের সাহিত্য তোমার কাছে দাবি করছে। সেইটি পৌঁছল না। তখন রথীন্দ্রনাথকে দিয়ে খবর পাঠালেন আবার। ‘বসন্ত’ নাটকটি উৎসর্গ করলেন নজরুলকে। বিদেশি ওয়ার্ডেন অবাক হয়ে গেলেন! এ কেমন কয়েদি যার জন্য নাটক লেখেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ! রবিঠাকুরের মৃত্যুর পর ‘বিশ্বের রবি ভারতে কবি’ আখ্যা দিয়ে ‘রবিহারা’ কবিতাটি নজরুল নিজেই রেকর্ড করলেন আকাশবাণীতে।
ব্যাপ্ত হৃদয়ের নজরুলকে নিয়ে লেখার জন্য কোনো শব্দসংখ্যাই হয়তো যথেষ্ট নয়। কারণ তিনি যে পরিমিতির ঊর্ধ্বে! তাই হয়ত বাঙালি তার ক্ষুদ্র হৃদয়ে ধারণ করতে পারেনি আজও তার সবটুকু। তাকে চেনার অনেকটাই বাকি। সেই চেনার কাজকে আরও কিছুটা সহজ করে তুলতে সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছে তার পরিবার। দেশের মাটিতেই নয়, বিদেশেও যাতে বর্তমান আর ভবিষ্যত প্রজন্মে ছড়িয়ে যায় নজরুলের জীবনদর্শন সেই জন্যই সম্প্রতি আমেরিকায় স্থাপিত হয়েছে তার পরিবারের তরফে ‘কাজী নজরুল ইসলাম ফাউন্ডেশন’। তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র এবং দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপি নিয়ে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রদর্শনীও। অবশ্য সব মানুষই যাতে এতে অংশ নেয় এমনটাই আশা করছেন নিউ জার্সি প্রবাসী নজরুলের নাতনি অনিন্দিতা কাজী।
ইংরেজি অনুবাদ, নানান ওয়ার্কশপ আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার ইত্যাদির মাধ্যমে বিস্তার করা হচ্ছে নজরুলের মতাদর্শকে। অনিন্দিতা আর তার স্বামী শাহিন তরফদার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন এর পাশাপাশি আমেরিকার নানান বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল নিয়ে কিছু লেকচারও আয়োজন করতে।