ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জলবায়ু পরিবর্তন ও ধরিত্রীর ভবিষ্যৎ

মোশারফ হোসেন
🕐 ১০:০৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৯, ২০১৯

জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বিশ্বব্যাপী চরম উৎকণ্ঠার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে এই ইস্যু। ক্রমশ জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে মূলত জলবায়ুর উপাদানগুলোর দীর্ঘমেয়াদি গড় পরিবর্তনের কারণে। প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই জলবায়ু এবং বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদানের পরিবর্তনে ঘটে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তজনিত ঝুঁকির নেতিবাচক প্রভাব মানুষের সভ্যতা, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি, লোকাচার-লোকরীতি, বিবাহ ব্যবস্থা, প্রচলিত প্রথা, শিল্প সাহিত্য, রীতি-নীতি, বিবাহ, ঐতিহ্য আচার-অনুষ্ঠান, জন্মহার মৃত্যুহার, অপরাধ প্রবণতা, মন-মেজাজের ক্ষেত্রে দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। বিশ্ব উষ্ণায়নের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অতি দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় কারণ হচ্ছে পৃথিবীপৃষ্ঠে মানুষের ক্রিয়াকর্ম।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্ব উষ্ণতার বৈরী প্রভাব পড়ছে। এসিড বৃষ্টি, জীবজন্তু ধ্বংসসহ নানাবিধ সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। অপরিকল্পিত শহরায়ন, শিল্পায়ন, অবাধে বন উজাড়, রাসায়নিক-সার ও কীটনাশক মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসানোর ফলশ্রুতি হিসেবে গ্রিন হাউসের প্রভাব, পাহাড়কাটা, কলকারখানা ও যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া, শিল্পের বর্জ্য, ই-বর্জ্য, অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়ানো, নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ রোধকরণসহ নানা কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় মেরুর বরফ গলতে শুরু করেছে। অপরিণামদর্শী হয়ে মানবজাতি যেহেতু প্রকৃতির বিপরীতে গিয়ে প্রতিযোগিতায় মত্ত তখন প্রকৃতিও তার পাল্টা জবাব দিচ্ছে নানা উপায়ে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। বাড়ছে ভ‚মিকম্প, উষ্ণতা বৃদ্ধি, শীতলতা, নদীর নাব্যতা হ্রাস, পাহাড়ি ভূমিধস, অতিবৃষ্টি, অকাল বন্যা, অনা বৃষ্টি, মরুকরণ, খরা, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, আইলা, ফনী, বজ্রপাত, সুনামি, ভ‚স্তরের ফাটল, দাবানল, উল্কাপাত, অগ্নুৎপাত, তুষারপাত ইত্যাদি। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রাণীজ আমিষের অন্যতম উৎস মৎস্য খাত নানা উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও সময়কাল পরিবর্তনের ফলে মাছের আবাসস্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র ক্রমশ সংকুচিত ও বিনষ্ট হচ্ছে। মহাসংকটে পড়তে যাচ্ছে দেশীয় মাছের অবাধ বংশবিস্তার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী দিনে পৃথিবীকে মোকাবেলা করতে হবে মারাত্মক সংক্রামক-অসংক্রামক বেশ কিছু সমস্যা। তৈরি হবে খাদ্য সংকট, মেরুতে বরফ গলা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বৃদ্ধি। উৎপাদিত ফসলের পুষ্টিমান হ্রাস পাচ্ছে বিশেষ করে ফসলের পুষ্টি উপাদান যেমন-জিংক, আয়রন কপার, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। যেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শেষঅবধি মানবদেহের ওপর। পরিণতি দাঁড়াচ্ছে রুগ্ন-শুকনো, মেধাহীন, দুর্বল চিত্তের অসুস্থ জাতি। দীর্ঘমেয়াদে খেসারত দিতে হচ্ছে পুরো জাতিকে।

এখানেই শেষ নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। খাদ্য ঘাটতি কারণে বাড়ছে আমদানি নির্ভরতা। শস্য উৎপাদন বৈচিত্র্যতার ঘাটতির কারণে প্রয়োজনীয় শিল্পের কাঁচামাল সংকট তথা শিল্প কারখানায় নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করে বলেন, প্রাকৃতিক জগতে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দিন পঞ্জিকায় আসবে ব্যাপক পরিবর্তন, শরৎকালের আগাম আগমনের ফলে হয়তো কিছু কিছু উদ্ভিদের পাতা গজানো, ফুল ফোঁটা, প্রাণীর ডিমপাড়া আগে বা পরে হবে। সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পানির অম্লত্বের কারণে সামুদ্রিক মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত, আবাসস্থলের পরিবর্তন ইত্যাদি হতে পারে। পোকামাকড় ও জীবাণু বিস্তার এবং সংক্রামণের হার বেড়ে যেতে পারে। ফলে অনেকাংশে বেড়ে যেতে পারে রোগব্যাধি ও মহামারী। পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না বহুপ্রাণী ও উদ্ভিদ। পরিণতিতে ঘটে চলেছে জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি। এর সঙ্গে আরও রয়েছে উন্নত দেশের চাপিয়ে দেওয়া নীতি বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড, স্লোবালাইজেশন, করপোরেট বিজনেস, বহুজাতিক কোম্পানি ইত্যাদি। নানাভাবে গরিব দেশের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। ক্ষতির প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। লেখক শহিদুল ইসলাম তার ‘সমাজ জীবন ও সংস্কৃতি’ বইয়ে বলেছেন, ‘ওয়ার্ড ওয়াইড লাইফ ফান্ড বলেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর আয়তনের সমতুল্য আরও দুই গ্রহের সন্ধান করতে হবে। কারণ এই সময়ের মধ্য পৃথিবীর সব সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে। সুতরাং বিশ্ববাসীকে সত্যজ্ঞানে উদ্বুদ্ধ হয়ে অসংযত জীবন পরিহার করে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার কিছুটা কমাতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেতনতা ফলদায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।’ বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগদ ঝুঁকির মধ্য থাকা বাংলাদেশের উপক‚লীয় জেলাগুলোর প্রায় ১৩ কোটি ৩৪ লাখ মানুষরে মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ১৪.৪ শতাংশ হ্রাস পাবে। বিশ্ব উষ্ণায়ন মানুষের স্বাস্থ্যেও সরাসরি প্রভাব ফেলবে। অধিক তাপমাত্রা-তাপমাত্রাজনিত রোগে বিভিন্ন প্রকার বায়ুবাহিত, পানিবাহিত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাবে। এ ছাড়া ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, অ্যাজমা-এলার্জি, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ডিহাইড্রেশন, অপুষ্টিজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে। তাতে জনস্বাস্থ্যের পরিকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্যে সংস্থার মতানুসারে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত কারণে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১,৫৪,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকে।

অদূর ভবিষ্যতে, অনাগত প্রজন্মের অস্তিত্বের প্রশ্নে সঠিক, সুন্দর, যথার্থ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে পরিবর্তিত আবহাওয়া জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবেলায় মানিয়ে নিতে না পারলে, প্রকৃতি সময়মতো পাল্টা-জবাব দিচ্ছে আরও দেবে। আখেরে সমাজ সভ্যতা তথা মনুষ্য জাতসহ সব প্রাণী হবে বিলুপ্তির পথের পথিক।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) থেকে প্রকাশিত বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের প্রতিবেদন-২০১৯-এ উঠে এসেছে, জীববৈচিত্র্য কমে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্য প্রায় ৫৭% মনুষ্য সৃষ্ট, প্রাকৃতিক সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত সম্পদ আহরণ। জীববৈচিত্র্যের বেড়ে ওঠার এলাকা কমে যাওয়া, পরিবেশ দূষণ ও ভূমির ধরনের পরিবর্তনকে দায়ী করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এর তথ্যানুসারে, ২০৩০ সালের পর নদীর প্রবাহ নাটকীয়ভাবে কমে যাবে। ফলে এশিয়ার পানির স্বল্পতা দেখা দিবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ জেমস হানসেন বলেছেন, ‘এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা কোনো সাধারণ ভয়ের বিষয় নয়, এটি নীরবে খেতে এসেছে বিশ্ব জনপদকে!’

মানুষ আজ যে পদক্ষেপ নিবে তাই নির্ধারণ করবে অনাগত প্রজন্মের অস্তিত্বের বিষয়টি। তাই কালক্ষেপণ না করে বিশ্বের সবাইকে এখনই সোচ্চার হতে হবে। শিল্পবর্জ্য শোধনাগার স্থাপন, নদীর নাব্যতা ঠিক রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, আন্তঃনদী সংযোগ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রিত উপায়ে সার-বিষ ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। পরিবেশের জন্য সরাসরি নেতিবাচক প্লাস্টিক পণ্য যেটি মাটিতে মেশে না এমন পদার্থের ব্যবহার বাদ দিয়ে পচনশীল দ্রব্য, পরিবেশের জন্য উপযোগী, স্বাস্থ্যসম্মত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে পাটের তৈরি পণ্যের ব্যাপক ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। সর্বোপরি ব্যাপক জনসচেতনতা ও সত্য জীবন দর্শনমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। যাতে তারা পরিবেশকে ধ্বংস না করে সংরক্ষণে অনুপ্রাণিত হয়।

মোশারফ হোসেন : শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]

 
Electronic Paper