ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দায়বদ্ধতার কথাশিল্পী

মোমিন রহমান
🕐 ১:১৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৩, ২০১৯

কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান এই পৃথিবীর আলো-বাতাসের মাঝে আর নেই। এখন তিনি ঘাসের নিচে শুয়ে আছেন মিরপুরের সরকারি কবরস্থানে। তবে লেখক রিজিয়া রহমান এখনো ভীষণভাবে জীবন্ত।

আমরা জানি, রিজিয়া রহমানের লেখক-সত্তাটির প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল কলকাতায়, সত্যযুগ পত্রিকায়। তখন তিনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী আর সেই লেখাটি ছিল, একটি কবিতা। পরে ওই পত্রিকায় রিজিয়ার আরও কয়েকটি লেখা ছাপা হয়। এর মধ্যে ছিল ‘টারজান’ নামে গল্প। এরপরে বেশ কয়েক বছরের বিরতি। ১৯৬০ সালে আবার লিখতে থাকেন রিজিয়া। গল্প, কবিতা। তবে গল্পই বেশি। পরে উপন্যাসেও হাত দেন। আর এই মাধ্যমেই তিনি অধিক পরিচিতি পান। কবিতা কি আর লিখেননি? তা লিখেছেন। বলা যায়, যখনই তার ভালো লাগত না তখনই ডায়রি খুলে কবিতা লিখতে বসতেন। তবে সেসব কবিতার খুব অল্পই প্রকাশিত হয়েছে।

অল্প কথায় রিজিয়া রহমানের কথাসাহিত্যের স্বরূপ বর্ণনা করা যায় এভাবে-তার গল্প-উপন্যাসে এদেশের মানুষের সংগ্রাম মূর্ত হয়ে উঠেছে। গণমানুষের যাপিত জীবন, চারপাশের অসঙ্গতি ও বৈষম্য ধরা পড়েছে রিজিয়ার সাহিত্য দর্পণে। সময়ের উত্তাপ আর মানুষের বিদ্রোহও অপূর্ব ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত তার লেখায়। তিনি ছিলেন এই মাটি ও মানুষের শিকড় সন্ধানী। অতীত আর বর্তমান কালের মানুষের দুঃখ-বেদনা-বঞ্চনার রূপকার। মানবতাবাদী।
রিজিয়া রহমানের প্রথম গ্রন্থ ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’।

১৯৬৭ সালে প্রকাশিত এই গল্পগ্রন্থের শিরোনাম গল্পটি রিজিয়া লিখেছিলেন তিতুমীরের ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইকে ঘিরে। পরে প্রকাশিত হয়েছে ‘নির্বাচিত গল্প’ (১৯৭৮), ‘চার দশকের গল্প’ (২০১১), ‘দূরে কোথাও’...। জীবন ও জগতের নানা বিষয় রিজিয়ার গল্পে ঠাঁই পেয়েছে। শব্দ প্রয়োগের বিষয়েও তিনি শুরু থেকেই সচেতন ছিলেন। যেমন ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’-র একটি গল্প, ‘লাল টিলার আকাশ’, এটি প্রকাশের সময়ে সমস্যা হয়েছিল। গল্পে ব্যবহৃত ‘হুইস্কি’ শব্দটির বদলে তাকে বলা হয়েছিল ‘শরাব’ বা ‘লাল পানি’ লিখতে। তিনি রাজি হননি।...গল্পকে নিয়ে রিজিয়া নিরীক্ষাও করেছেন। সেই নিরীক্ষার স্বাক্ষর রয়েছে তার ‘দূরে কোথাও’ গল্পগ্রন্থে।

উপন্যাসের ক্ষেত্রে বলা যায়, বাংলাসাহিত্যে না হলেও এ দেশের সাহিত্যে রিজিয়া কয়েকটি বিষয়ে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। যেমন তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘ঘর ভাঙ্গা ঘর’ (১৯৭৪)। বস্তির মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা-ক্লেদ নিয়ে রচিত এই উপন্যাসটি এ দেশের উপন্যাসের ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করে।...একই কথা প্রযোজ্য ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও। কেননা এতে মূর্ত হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামে হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্বের চিত্র।

রিজিয়াই প্রথম এ দেশের দেহপসারিণীদের মানবেতর জীবনযাত্রা দরদি কলমে তুলে ধরেন। ঢাকার ইংলিশ রোডের কান্দুপট্টির অধুনালুপ্ত পতিতাপল্লীর পটভূমিতে লিখিত ‘রক্তের অক্ষর’ (১৯৭৮) উপন্যাসটির ক্ষেত্রে রিজিয়ার কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। অর্থাৎ তিনি সেই পতিতালয়ে কখনোই যাননি। এক্ষেত্রে তার পুঁজি ছিল সাপ্তাহিক বিচিত্রার এক সাংবাদিকের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-পতিতারা কীভাবে ওই পতিতালয়ে পৌঁছেছে, কীভাবে তারা জীবনযাপন করে ইত্যাদি।

এ ছাড়া ওরা যে ধরনের ঘরে থাকে সেসব ঘরের ছবি তুলে এনে রিজিয়াকে উপহার দিয়েছিলেন বিচিত্রার আলোকচিত্রী আল মাজী। এ থেকেও পতিতাদের যাপিত জীবনের কিছুটা ধারণা পেয়েছিলেন তিনি।...‘রক্তের অক্ষর’ সেই সময়ে পাঠকদের আলোড়িত করেছিল। তবে এক শ্রেণির সমালোচক সমালোচনার তীর ছুড়ে বলেছিলেন, আবেগে ভরপুর এই উপন্যাস। উপন্যাসের ইয়াসমিন চরিত্রটিও তাদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছে।

আরোপিত মনে হয়েছে উপন্যাসের শেষাংশটি- যেখানে ইয়াসমিনকে হত্যা করে হত্যাকারী ছুরির রক্ত মোছে ইয়াসমিনের পড়া এক বইয়ের পাতা ছিঁড়ে, সেখানে লেখা ছিল সেই অমর বাণী : “ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি বাট এভরিহোয়্যার হি চেইঞ্জড”। কিন্তু এটাও সত্যি রিজিয়ার এই উপন্যাসটি এদেশের কয়েকজন লেখককে প্রভাবিত করেছিল, এমনকি অন্য শিল্প মাধ্যমের স্রষ্টাকেও। যেমন চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন তার ‘কসাই’ ছবির একটি দৃশ্যে দেখান- কোরআন শরিফ পড়ারত পতিতা রোজিনাকে হত্যা করে হত্যাকারী চলে যায় আর রোজিনার দেহের রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ে কোরআনের পাতার ওপর।

রিজিয়ার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘বাঘবন্দি’। এখানে তিনি বর্তমান বাংলাদেশকেই তুলে ধরেছেন। ‘বাঘ’ মানে ভয়। এই ভয়কে বন্দি করার কথা বলেছেন রিজিয়া। উপন্যাসের শেষে সমুদ্রকেও প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, ঘুমন্ত জনপদের দিকে সে ক্ষেপে উঠতে চাইছে অর্থাৎ ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে, যা বিস্ফোরিত হবে। আবার জিয়াউর রহমান যখন স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রী করতে শুরু করেছিলেন, তখন সেটির প্রতিবাদ হিসেবে রিজিয়া লিখেছিলেন ‘একটি ফুলের জন্য’। ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাসে রিজিয়া ইসলামী জঙ্গিবাদের শিকড় ধরে টান দিয়েছেন। উন্মোচন করেছেন এর স্বরূপ। এ ছাড়া ‘অলিখিত উপাখ্যান’, ‘শিলায় শিলায় আগুন’, ‘সূর্য সবুজ রক্ত’ এবং ‘আবে রওয়াঁ’-ও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম।

গল্প-উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কেও রিজিয়া সচেতন ছিলেন। এই বিষয়ে তার ভাষ্য ছিল, “এখন এই ২০১৫-তে এসেও আমি বঙ্কিমের ভাষায় উপন্যাস লিখতে পারি না। কিংবা শরতের মতো গল্পের ভাষা এখন কেউ লিখবে না। এটা মনে রাখতে হবে যে লেখার ভাষাটা যেন উন্নত ও সমসাময়িক হয়।”...বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষার ফারাক সম্পর্কেও তিনি সচেতন ছিলেন। ‘সন্ধ্যা’-কে ‘সন্ধে’ কিংবা ‘দেখাশোনা’-কে ‘দেখভাল’ লিখতেন না তিনি। ‘নারী লেখক’ অভিধায় রিজিয়া বিশ্বাসী ছিলেন না।

তিনি মনে করতেন, লেখক সত্তাটি নারী-পুরুষের ঊর্ধ্বে। একজন নারীই নারীদের মনস্তত্ত্ব ভালো বোঝেন-এটিও তিনি মানতেন না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, রিজিয়া রহমান এদেশের মাটি ও মানুষের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। শিল্পের জন্য শিল্প তার অন্বিষ্ট ছিল না। অর্থের কাছেও নিজের সাহিত্যিক-সত্তাকে তিনি বিকিয়ে দেননি।

 
Electronic Paper