চামড়ায় নয়ছয়
জাফর আহমদ
🕐 ১০:৪৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৭, ২০১৯
আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের কৌশল এবং সরকারের পর্যবেক্ষণের অভাবে কাঁচা চামড়ার দামে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান সহসাই হচ্ছে না। সিন্ডিকেট হলেও দুপক্ষই একে-অন্যকে দোষারোপের কৌশলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোরবানির ঈদের দিন সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির কথা ঘোষণা দিয়েও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি।
এদিকে গতকাল শনিবার থেকে ট্যানারি মালিক চামড়া কেনার ঘোষণা দিলেও আড়তদাররা তাদের পাওনা টাকা না পাওয়া পর্যন্ত চামড়া বিক্রি করবে না বলে জানায়। এতে নতুন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ঈদের চার দিন অতিবাহিত হলেও এখনো চামড়ার বাজারের নয়ছয় দশা কাটছে না। এ বছর কোরবানিতে প্রায় এক কোটি ১৮ লাখ পশু জবাই হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪৫ লাখ গরু। বাকি পশুগুলো-ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য পশু। এসব চামড়া বেচাকেনায় দেড় হাজার কোটি থেকে দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেন হওয়ার কথা ছিল।
এ বছর চামড়ার দাম স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে আসায় পথে বসে চামড়ার ছোট্ট ব্যবসায়ী ও গরিব চামড়া সংগ্রহকারীরা। চামড়ার দাম না পাওয়া এবং বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্ট হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ। এ খাত থেকে এ বছর বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল তা থেকে বঞ্চিত হবে। আড়তদাররা বলছেন, ট্যানারি মালিকরা টাকা না দেওয়ার কারণে চামড়া কেনা যায়নি। গত বছরের পাওনা টাকাও ট্যানারি মালিকরা ফেরত দেয়নি। এ কারণে চামড়ার দাম সর্বনিম্নে নেমে আসে। অনেকেই রাগে-ক্ষোভে চামড়া পাটিতে পুঁতে ফেলেন। ট্যানারি শিল্প মালিক সমিতির হিসাবে মাটিতে পুঁতে ফেলা চামড়ার পরিমাণ মোট চামড়ার প্রায় ১৫ শতাংশ।
এদিকে ট্যানারি মালিক সমিতির পক্ষ থেকে আড়তদারদের অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। সমিতির সভাপতি শাহীন আহমেদ জানান, কোরবানির ঈদে চামড়াকেন্দ্রিক দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। আর আড়তদার পর্যায়ে চামড়ার ক্রয়ে লেনদেন হয় ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। ফলে চামড়ার দাম না পাওয়ার পেছনে আড়তদাররা ট্যানারি মালিকদের ওপর যে ঢালাও দোষ চাপাচ্ছে এটা সঠিক নয়। তবে সাভারে ট্যানারি শিল্পে ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতে পারছে না, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার না থাকার কারণে ইউরোপের ক্রেতারা চামড়াজাত পণ্য কেনার কার্যাদেশ দিচ্ছে না।
এ ছাড়াও চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য বৈরিতার কারণেও ট্যানারি শিল্পগুলো বিপদে আছে। এ কারণে টাকা ছাড় করতে পারেনি। চামড়ার শিল্পের উদ্যোক্তারা মনে করছে, চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার ও ট্যানারি মালিকরা মিলে বাজার পর্যবেক্ষণ করলে চামড়া নিয়ে এমন নয়ছয় হতো না।
চামড়া নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা দূর করতে সরকারের শেষে দিকে কাঁচা চামড়া রপ্তানির ঘোষণা দিলেও চামড়ার দাম ফেরাতে খুব একটা কাজে আসেনি। ততক্ষণে চামড়া যা নষ্ট হওয়ার কথা তা হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে চামড়ার দাম না পেয়ে অনেকেই চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলে দিয়েছে এবং কেউ কেউ ফেলে দিয়েছে। যারা চামড়া কিনেছে তারাও দাম না পাওয়ার অনিশ্চয়তায় অতিরিক্ত টাকা দিয়ে লবণ কিনে আরও টাকা লোকসান গুনতে চায়নি। ফলে কাঁচা চামড়া রপ্তানি করার ঘোষণায় চামড়ার বাজার চাঙ্গা করতে চাইলেও দেরিতে ঘোষণা আসার কারণে চামড়ার বাজারে অনিশ্চয়তা দূর করতে তা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গতকাল শনিবার পর্যন্ত চামড়া রপ্তানির ব্যাপারে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এ কারণে চামড়ার মালিকরা লোকসান গোনার পরও রপ্তানিকারক ও আড়তদারদের মুনাফা করার যে সম্ভাবনা ছিল সেখানেও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
কাঁচা চামড়া রপ্তানি নিয়ে সরকারের ঘোষণাকে ‘দেরিতে দাওয়াই’ বলে সমালোচনা করেছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশের শর্তে খোলা কাগজকে তিনি বলেন, সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির ঘোষণা ঈদের আগে দিলে আড়তদাররা চামড়া কিনত। ফলে চামড়ার দামে ধস নামত না। মানুষ টাকা পেত, চামড়া মাটিতে পুঁতে নষ্ট হতো না। দেশের সম্পদ চামড়া নষ্ট হতো না। চামড়ার বাজারও সিন্ডিকেটের দখলে যেত না।
চামড়া কিনতে যাতে টাকার অভাব না হয় সে জন্য সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক ৬০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছিল। শর্ত পূরণ করে ট্যানারি মালিকরা ব্যাংক থেকে ওই টাকা চাইলেই পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেক ট্যানারি মালিক খেলাপি হওয়ার কারণে এবং অন্যরা সাভারের শিল্প নগরীতে কারখানা প্রতিষ্ঠিত করেও জমির দলিল না পাওয়ার কারণে ব্যাংকের ওই টাকা নিতে পারেনি। ফলে সরকার অর্থ বরাদ্দ করলেও তা অনেকটা ‘গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল’-এ পরিণত হয়েছে। তবে আড়তদারদের মতে, কেউ কেউ ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারলেও তারা তা মাঠপর্যায়ে সরবরাহ করেনি। ঘাঁপটি মেরে বসে ছিল। এখন কম দামে চামড়া কিনে তা মজুদ করবে।
এ দিকে বাজার সামলাতে সরকারের অনুরোধে ট্যানারি মালিকরা কাঁচা চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিলেও আড়তদাররা বিক্রি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়ায় সংকট নতুন মাত্রা পেল। গতকাল শনিবার বৈঠক করে কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেছেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া ‘শত শত কোটি টাকা’র সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তারা চামড়া বিক্রি করবেন না। এর প্রতিক্রিয়ায় ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, সরকারের অনুরোধে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী তারা শনিবার থেকে কাঁচা চামড়া কিনতে তৈরি হলেও আড়তদাররা বিক্রি না করলে তাদের কিছু করার নেই।
ঋণের শর্ত শিথিল করে টাকা প্রস্তুত রেখেছি : মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম, এমডি, অগ্রণী ব্যাংক লি.
কোরবানির ঈদকেন্দ্রিক চামড়া ক্রয়ের জন্য আমরা ব্যাংকে টাকা প্রস্তুত রেখেছি। কেউ কেউ ঈদের আগে টাকা নিয়েছেন। হয়তো পরেও কেউ কেউ নেবেন। ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমরা চেয়েছি, টাকার অভাবে যাতে কোনো ব্যবসায়ী চামড়া কিনতে সমস্যায় না পড়েন। টাকা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা পান সেই ব্যবস্থা করেছি। চামড়া কেনা সহজ করতে এ বছর ঋণের শর্ত শিথিল করেছিলাম। আমাদের নির্দেশনা আছে, যে উদ্যোক্তা আগের বছরের পুরো ঋণ পরিশোধ করবে তাকে এ বছর পুরো টাকা দেওয়া হচ্ছে। গত বছরের ঋণ যারা আংশিক পরিশোধ করবেন তাদের সমপরিমাণ ঋণ দেওয়া হবে। আগের বছরগুলোতে নির্দেশনা ছিল, কোনো উদ্যোক্তা টাকা নিয়ে কোনো অংশ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে তাকে কোনো টাকা দেওয়া হতো না।
দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে : ড. তৌফিক আহমেদ চৌধূরী, সাবেক মহাপরিচালক, বিআইবিএম
বাজারের নিয়ন্ত্রণ বাজারের ওপরই ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু বাজার যখন অচল হয়ে পড়ে তখন সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। চামড়ার দামকেন্দ্রিক যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সরকার সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। মানুষ চামড়ার দাম না পেয়ে পুঁতে ফেলেছে। এতে দেশের ক্ষতি হয়েছে। সরকার চামড়ার দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে চামড়া রপ্তানির যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটা ভালো উদ্যোগ। তবে এ সিদ্ধান্ত খুব একটা কাজে আসেনি। এটা ঈদের কয়েকদিন আগে করার দরকার ছিল। কারণ চামড়া রপ্তানির বার্তাটি মানুষের কাছে আগে যাওয়ার দরকার ছিল। সেটা হয়নি। তবে একটি থ্রেট হয়েছে। ঈদের কয়েকদিন আগে চামড়া রপ্তানির ঘোষণা দিলে চামড়ার দামে এত বিশৃঙ্খলা হতো না।
চামড়ার পুঁতে ফেলা কোনো ছোট্ট ঘটনা নয়। এটি চামড়া শিল্পের জন্য একটি খারাপ বার্তা। কাদের গাফিলতি ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে চামড়া পুঁতে ফেলার মতো অবস্থা সৃষ্টি হলো তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে।