ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ঈদস্মৃতি

ভেঁপু-বাঁশি আর বাস্না সাবানের ঈদ

পাপড়ি রহমান
🕐 ২:৪৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৯, ২০১৯

আমাদের ঈদ আসতো নতুন সাবানের মোড়কে ভর করে। আব্বা বা দিদিকে দেখতাম সাবান কেসে সাবান থাকা সত্ত্বেও নতুন কেনা সাবানের মোড়ক খুলে ভোর ভোর গোসল সারতেন। সাবান মানে এখনকার মতো হরেকরকম সাবান নয়। সাবান বলতে তখন লাক্স এবং কসকো গ্লিসারিন সোপ। লাক্স তাও একরঙা-শাদা, শুধুই শাদা। অসম্ভব পবিত্রতায় উপচানো তার সুরভি। আর কফিরঙা কসকোর ভেতর-বাইরে ছিল নিপাট ভদ্রলোকি, একেবারে সিল মেরে দেওয়া বনেদিয়ানা। অনেক পরে লাইফবয়। লাইফবয় আমাদের বাড়িতে আসতোই না, আসতো স্যাণ্ডেলিনা চন্দন সাবান। আহা! চারপাশে চন্দনের ভুরভুরে সুঘ্রাণ নিয়ে শুরু হতো আমাদের ঈদের পরব! আমাদের দুই পুকুরের দুইপাশে গ্রামের অনেকেই গোসল সেরে নিত।

সাবান কেসে নয়, তারা সাবান নিয়ে আসতো খড়ে পেঁচিয়ে বা সিগারেটের প্যাকেটে পুরে। ক্ষয়ে যাওয়া আধখানা সাবান- যাকে মা-চাচিমারা বলতো ঢিমা সাবান অথবা বাংলা সাবান। এসব সাবান দিয়ে আমাদের বাড়িতে পুরাতন কাপড় বা বিছানার চাদর-মশারি-কাঁথা কাচা হতো। আম্মাকে দেখতাম দামি কাপড়চোপড় জেট পাউডারে কেচে নিতে। যারা ওই ঢিমা বা বাংলা সাবানে ঈদের গোসল সেরে নিত, তাদের আনন্দে কিন্তু ভাটা ছিল না। তাদের ঈদেও ছিল ভরভরন্ত জোয়ার। ঈদের অমলিন আনন্দ বাংলা সাবান বা ঢিমা সাবানের তলায় চাপা দেবার উপায় ছিল না। ওইসব সাবানেও ফেনা হতো অঢেল। এত ফেনা হতো যে, পুকুরের জল ফেনায়িত ঢেউ নিয়ে ভেসে বেড়াতো! আমাদের বাড়ির দিকের ঘাটগুলোতে গ্রামের অন্য কেউ গোসল করার অনুমতি পেত না। এসব ঘাট আমাদের নিজেদের গোসলের জন্য সংরক্ষিত রাখা হতো।

আরও কিছু বিষয় ছিল, আমাদের বাড়ির উঠোনের ভেতর দিয়ে অন্যদের যাওয়া বারণ ছিল। গ্রামের লোকজন চলাচল করতো বাইরবাড়ি দিয়ে। এই বাইরবাড়ি দিয়ে গ্রামের লোকজন ঈদগাহের উদ্দেশে হেঁটে যেত। আমরা তখন নতুন জামাকাপড় আর জুতোমোজা পরে ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখতাম।

দেখতাম, পরীর মতো ফুটফুটে ছোট ছোট মেয়েরা কানের একপাশে গোলাপি বা ম্যাজেন্টা রঙের ফিতা দিয়ে বড় বড় ফুল তুলে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাচ্ছে। আমার মন খারাপ হয়ে যেত ওদের ওড়াউড়ি দেখে- কিন্তু ওরকম প্রজাপতি হওয়া আমার জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল! কারণ আমার অমন কোনো ফিতাই ছিল না। আম্মা আমার চুল বেঁধে দিতেন সাটিনের ফিতা দিয়ে, তাও দুই ঝুঁটি করে দিলে। নইলে ছোট করে ছাঁটা চুল আটকে দিতেন আব্বার কিনে আনা ব্রোকেটের ব্যান্ড দিয়ে বা কোনো হেয়ার ক্লিপ দিয়ে। ওইসব পরীদের জামাকাপড়ও ছিল গাঢ় গোলাপি বা ম্যাজেন্টা রঙা। এদিকে আমাকে পরতে হতো অফ হোয়াইট বা পার্পল রঙা নেটের জামা! পরীদের ঠোঁট রাঙানো থাকতো টুকটুকে লাল বা গাঢ় গোলাপি রঙের লিপস্টিকে। তারা প্রায় হাঁ করেই হেঁটে যেত, হয়তো লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে মুখ বন্ধ করতো না! এদিকে আমি আমার রঙহীন ঠোঁট নিয়ে বিরস বদনে ঘুরে বেড়াতাম এঘর-ওঘর! লিপস্টিক দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতাম না! বলাও যেত না, এই আবদার ধরলে নির্ঘাত আম্মার তিরাশি মন ওজনের থাপ্পর আমার দুই গাল ফাটিয়ে লাল করে দেবে!

তবে ঈদগাহর নামাজে ছোট ছোট সব পরীদেরই যাওয়ার এখতিয়ার ছিল। ফলে আমিও যেতাম আব্বা-চাচাদের সাথে। আব্বা যেত পাঞ্জাবি-পায়জামা-স্যান্ডেল পরে।

জায়নামাজ ঘাড়ে ফেলে। দাদা বা চাচারাও তাই। ঈদের জামাত শুরু হলে আমরা একেবারে পেছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আর লোভী চোখে তাকিয়ে থাকতাম সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা বেলুনওয়ালাদের দিকে। যারা সুতোয় বাঁধা একগুচ্ছ বেলুন হাতে ধরে মুখের বাঁশিতে ঘনঘন ফুঁ দিয়ে প্যাঁ পোঁ করে চলেছে। দুই-একজন পরীর হাতে লাল বা নীলরঙা বেলুন! আমার তর সইতো না-কখন আব্বার নামাজ শেষ হবে? আর নামাজ শেষ হলেই বা কি? আব্বা বহুলোকের সাথে ঈদের কোলাকোলি শেষ করেই না দুই/একটা বেলুন আমায় কিনে দেবে।

আদতে আমাদের ঈদ ছিল ওই রঙিন বেলুনবাঁশির প্যাঁ পোঁ সুরের মাঝে। বেলুনবাঁশি বাজিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দে আমাদের ঈদ মাখামাখি হয়ে যেত! আর আমাদের ঈদগাতে যাওয়ার দুর্মর আকর্ষণ ছিল ওই বেলুনবাঁশিওয়ালরাই। তাদের হাতে ধরা গুচ্ছ গুচ্ছ বর্ণিল বেলুনের মাঝে আমাদের ঈদের আনন্দ হুটোপুঁটি খেত। আমরা সেসবের কিছুটা মুঠোতে পুরে বড়দের হাত ধরে বাড়ি ফিরতাম। ফিতা বাঁধা ফুলপরীদের মুখগুলিও তখন সকালের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে!

 
Electronic Paper