ভুল বানানে বেজে ওঠে গিটার
কামরুল ইসলাম
🕐 ২:৪০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৯, ২০১৯
জানালার পর্দা তো টেনেই দিয়েছিলাম, হঠাৎ কয়েকজন তাগড়া যুবক এসে আস্তে আস্তে পর্দা সরিয়ে আমাকে দেখালো নেড়ে কুত্তার চিৎকার। অতঃপর ওরা আমাকে টেনে-হেঁচড়ে রাস্তায় নামালো, কয়েকজন বৃদ্ধ তাড়িখোর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে সমস্বরে বললো- দ্যাখ শালা কত বড়ো ‘ক’! সম্মোহিত আমি বিশাল ‘ক’-এর ভেতরে ঢুকে যেতে থাকি, দেখি আমার নিজস্ব আড়াল বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে আমারই পাশে। বুলেটবিদ্ধ বকের ডানায় জমে থাকা উড়াল যেভাবে ধীরে ধীরে নিভে যায়- সেই প্রদোষে, সেই রক্তে ভেজা অন্ধকার পথে কিংবা এক প্রাচীন দেয়ালে সাঁটানো আবেগের রুগ্ন স্যাটায়ারগুলো ছিঁড়ে ফেলে স্মিতহাস্যে সেই আড়াল এসে হাত ধরলে আমি নিজেকে অন্ধ হোমারের পোশাকে দেখতে পাই, আমার প্রিয়তম আড়াল আমাকে কোকিলের ছিঁড়ে-যাওয়া গান বিছানো পথে দাঁড় করিয়ে চলে যায়, আমি কি সেই পথে, সেই রুগ্ন পাখির চোখের আলপথ ধরে হিম রাত্রির করুণ বেহালা বাজাতে বাজাতে আর বাড়ি ফিরবো কখনো? বাড়ি নামক যে পদ্য আমরা লিখে গেছি এতদিন, তা আসলে আমাদের ছিন্নভিন্ন আত্মার ক্যানোপি, উন্মাদ শকুনেরা যেখানে রাতের মতো বেজে ওঠে আর চেঁচিয়ে বলে- এই তো আমার আলো!
ছায়ার গভীরে যে ছায়া উথলে ওঠে, সেই ছায়াতলে হাড়-হাড্ডির কথোপকথন নিয়ে যে রাস্তা নেমে গেছে উজানতলি গ্রামে, সেই গ্রামের কুয়াশা-ঢাকা অতীতের দিকে হেঁটে যাওয়া এক নিঃস্ব পথিক উপড়ানো পাকুড়তলে দাঁড়িয়ে বলে যায়- ‘সমস্ত আদিমতার মধ্যেও তুমি দেখতে পাবে স্পন্দিত শস্যের গান, আর তোমরা শীতসন্ধ্যায় শরীরে কম্পন নিয়ে যে পোস্টারগুলো লিখে যাচ্ছো সেগুলো লোরকার ছিন্নভিন্ন দেহের মতো পবিত্র- এই বিশ্বাস নিয়ে নেমে যাও বৃষ্টি ও বাতাসের বিবিধ চেতনায়।’ স্পন্দিত শস্যের গান শোনার অপেক্ষায় কত দিন কত রাত আমি আকাশ-ভূমির নিকটাত্মীয় হয়ে, বনভূমির অনন্ত সবুজ কিংবা ধূসরতা বুকে মেখে হেঁটেছি কত পথ, কিন্তু কেন যেন আমি শুধু পেছনে পেছনে মরা নদীর কাতরানো শুনি, শুনি কত বেড়ালের কান্নার ধ্বনি, অতঃপর আমার মনোজগতের নোনাজল ধরে একটি জাহাজের কম্পন আমাকে আবার ফিরে নিয়ে যায় জনারণ্যের সেই শুরুতে! আমাদের শুরু আর শেষের গল্পে যে বিষাদ জমে আছে, শত শত বছর, তার হিসেব নেবার জন্যে আমাদের কেউ আর ডেকে বলে না, এসো হে, এই ডিঙি নৌকোর গলুইয়ে বসে একটু জেনে নিই বটতলার পুরনো গল্পগুলো। কেউ আর বলে না! তবু অসম্ভব সাঁতারের ভাঁজে ঘরে ফেরার মানচিত্র দেখি, আর আমার মনে পড়ে যায়, একটি চোখ কীভাবে মেঘের অন্তরে জমে থাকা শীতল বরফ গলিয়ে বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে রাতের অলিন্দে মিশে থাকে। নিশ্চিন্ততার বন্ধন নিয়ে এইসব খেলা কাশফুলের অমিত অক্ষরে জেগে থাকে-আমরা দলবেঁধে দেখতে থাকি একটি চোখ, অশ্রু ও মায়ায়, বৃষ্টির প্রমিত ভাষায়!
আমাদের দিগন্ত প্লাবিত মন চুঁইয়ে প্রতিদিন যে সূর্য ওঠে, প্রতিদিন যে কুয়াশার মধ্যে আমরা মরণের পাল তুলে পরিপূর্ণ পথিক হয়ে উঠি, সে নিয়ে আর কোনো সংগীত রচিত হবার আগে আমাদের ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠে আড্ডার করুণ ক্লান্তি, সন্ধ্যার জলে ভেসে ওঠা অসুস্থ মাছেদের প্রার্থনা। ভাবনার গলিতে দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারে হারানো একটি তালগাছ, যেখানে একদিন আগাছারা নিজ নিজ প্রতিভার সপক্ষে নিশান উড়িয়ে, বানর-পট্টির কবিতা লিখে, অন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সেই গল্প আজো জমে আছে পালক-ঝরানো চাঁদপাখির ডেরায়। আমরা ভুলিনি, অস্তগামী সূর্যের পাশ ঘিরে কতসব নদী বিধবা হলো কপালের দোষে- আমরা কি কখনো সকরুণ বাতাসে বাতাসে পাখিদের ছায়ার দিকে উন্নীত হবো? আমাদের দেহ কি ভেষজ লতাদের গানের দিকে ভাসাবে তরণী, মধ্যরাতে কখনো? তবু শুনি, বৃক্ষদের ডানা মেলার শব্দ শুনি, দেখি, কুজন-মুখরিত ভোরের দিকে ফুল-ফোটার আয়োজন; শুধু একটি বালিকা নদীর ফিরে আসার গানগুলো আর শুনি না, শুনি না, রিটা কিংবা রেহেনারা ফেলে যাওয়া পথের মাথায় দাঁড়িয়ে, পৌষের কোনো নরম বিকালে, শৈশবের ধান-কুড়ানো মাঠের কথা ভেবেছিল কিনা!
তবু রাত নামে, আর সম্ভাব্য ভোরের আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে চারদিক, অন্তহীন বেদনায় পৃথিবী কাঁপে আর একদল মানুষ অন্ধকারের রঙ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কী এক মারাত্মক নেশায় ছুটে চলে মনোজগতের বেড়া ভেঙে- তারা ভাবে, এ জনম পুরনো পাতার লাস্যময়ী দুপুর মাত্র, যার ভেতরে জমে আছে ক্লান্তি ও তার দৃশ্যসমূহ বিবিধ সখ্যে কোথাও গোপন জলে গজার মাছেরা ঘাঁই মারে আর খুলে যায় অন্তরীক্ষের বিপুল ইশারা, পাতাঝরা লাল দুনিয়ার পথগুলো— আমি রেমব্রাঁ’র রঙের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি আর অন্ধকারের লিথোকোড ভেঙে বুঝে নিই, আমিও এক অ্যাম্ফিবিয়ান সলিলিকির ভারে জলে ও ডাঙায় মাটি-ঘাস থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। অনন্ত গ্লানি ও কালিমায় মানচিত্রের বিবরে ঘাস ও রক্তের ছোপ ক্রমশ লুপ্ত হতে থাকলে একটি খাদ থেকে আরেকটি খাতে কার্বনী উৎসবের থিম সং বেজে ওঠে... তখন চরাচরে কোনো জাগৃতি নেই- স্মৃতিহীনতার অভিশাপ নিয়ে এই যে বেঁচে থাকা, এই যে পুরনো দাঁড় আর চলছে না, শুকনো গঙ্গার তীরে ক্ষুধার্ত হার্বারিয়াম কলেরিক রাতের মতো জমে আছে নেশায়!
জলের কিনারে এসে দেখি ক্রিপটিক ভোর অন্ধ হয়ে বসে আছে উজাড় বনভূমির কাছে। খোয়াজ খিজির দেখো ওই উত্তপ্ত বালুচরে স্বপ্নের বয়েম খুলে প্রাজ্ঞ নির্মিতির জল খুঁজে খুঁজে নিজের হাড়ের ভেতরে বেজে চলা সেতারের দিকে হাত বাড়াচ্ছে- পতনের দিকে গণলিঙ্গের উত্থানরহিত যাত্রাকালে আমাদের মনে হতে থাকে ‘খলাক্তু’ বলে যে পালিয়ে গেল নিজেরই ডানার আক্রোশে, তাকে আজ ভুবন-ভুলানো স্যাড মেলডির আবীর মাখিয়ে কারা যেন জেনে নিতে চাচ্ছে- হোয়াট দ্য টুইলাইট মিনস হোয়েন এভরিথিং ইজ গোয়িং ইনটু অব্লিভিয়ন...
মরচুয়ারির পাতায় আমাদের পা আটকে যায়, খোয়াবের বিন্দু বিন্দু ঘামে শ্রম খোয়ানোর লীলাখেলায করপোরেট শৌচাগারের দরজায় যার ছবি সেঁটে দেওয়া- সে কি অগণিত বেশ্যার খসে যাওয়া চোয়ালের মেলোড্রামা, নাকি এক কদর্য ক্যালিবান জ্বলে আছে সময়ের মোমে- এসব কথা আফগান, সোমালিয়া, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন কিংবা সিরিয়া, তুরস্ক হয়ে ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরের কিনারে দাঁড়িয়ে ক্রসফায়ারের সিমিলি-মেটাফর নিয়ে উড়ে বেড়ায়...নিরঙ্কুশ সাঁতারের জলে ভুল বানানে বেজে ওঠে গিটার-
মুখ ও মুখোশের ভেতর সূর্য উঠছে- ভেঙে যাচ্ছে সমুদ্র যাত্রার কাহিনী- রাতের নারকেল পাতায় মন ভাসছে আরোগ্য বাড়ির আঙিনায়- ঐ দূরে চন্দ্রগ্রাম ভাটিয়ালি ছিঁড়ে শিখে নেয় অন্য কোনো সুরের মহতি- রাত আসে ঘুমের শহরে, নূপুর ও নিক্কনে ভরে যায় বিস্তৃত সাধনা- জানালায় কার মৃত মুখ- ডেকে যায় ডাকিনীর মতো শতেক ব্যঞ্জনে! দর্শনের খেয়াঘাটে এসে ভোরের জন্য বসে আছে সাবঅল্টার্ন, পাশে আছে মৌনমিছিলের ছায়া, কবেকার জংধরা হলোকাস্ট নিয়ে গবেষণার দিকে সাত-আটটি মাকড়সার খোলস উড়ছে দুপুরের সৌখিন বাতাসে- এ সময়ে আমি আর মেথরপট্টীর আকাশে চাঁদোৎসবের রণকৌশলে তাকাবো না একটুও!
যে-জীবনের আর কোনো গল্প থাকে না, সে-জীবনও মানুষ অতি যত্নে ধরে রাখে- এ-রকম ভাবনার দিকে নেমে এলো সাঁতার না-জানা কিছু কবিতা- এসব আমি মেঘের আঁচলে বেঁধে দিয়ে মাছ ও বৃষ্টির অপভ্রংশে এসে দাঁড়ায়- গোধুলির নীরব মঞ্চটি ঝরে পড়ছে আমার মাথায়, আর একে একে দোয়েল, ফিঙ্গে, মাছরাঙা এসে বলে যাচ্ছে- সাইলেন্স ইজ নট অ্যান আর্ট, রিমেম্বার!
স্মরণে আছে মৃত্যুর কুহেলিকা জড়িত সেই সকালের কথা, যেদিন মেঘের আলমারি ভেঙে সবগুলো বৃষ্টির গল্প চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল, ঘুম ঘুম চোখে, এক পরিচিত তস্কর। বৃষ্টির গল্পগুলো হারিয়ে গেলে খাঁ খাঁ মাঠের বন্য বাতাস এসে জানিয়ে যায়, হিলিয়াম-মুখরিত একটি মুখ জীবনের গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘুমের শহরে; বনপথে তখন রচিত হতে থাকে ঘুম-তাড়িত শস্যের গান, অতঃপর আহত উপমারা দল বেঁধে ললিতকলার পাঠ নিতে থাকে আর ফুটন্ত গোলাপের সুরে গাইতে থাকে- মাই ডিয়ার, গো ডাউন দ্য স্ট্রিট অ্যান্ড এনজয় ডেথ উইথ ব্রাইট থার্স্ট!