ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আমার মানিক ভাই

শেখ মুজিবুর রহমান
🕐 ১:৩৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৭, ২০১৯

স্বাধীনতা সংগ্রামে মানিক ভাই’র অবদানের কাহিনী অনেকেরই অজানা। পক্ষান্তরে, আমার ব্যক্তিগত জীবনে মানিক ভাই’র প্রভাব যে কত গভীর, তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। ১৯৪৩ সাল থেকে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। সে পরিচয়ের পর থেকে সারাটা জীবন আমরা দু’ভাই একসাথে জনগণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম করেছি। সে সংগ্রাম সাধনার পথের বাঁকে বাঁকে একে যে অন্যের প্রতি কোনদিন মান-অভিমানও করিনি, তা নয়। তবে তা ছিল ক্ষণিকের বিভ্রমের মতো।

একটা বিষয়ে আমরা উভয়ই একমত ছিলাম। এবং তা হলো, বাংলার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ভিন্ন বাঙালির মুক্তি নেই, এ বিষয়ে আমাদের মাঝে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল না। আর ছিল না বলেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও দু’জন দু’ফ্রন্টে থেকে কাজ করেছি। আমি কাজ করেছি মাঠে-ময়দানে আর মানিক ভাই তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর সাহায্যে। দৈহিক অর্থে মানিক ভাই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর স্মৃতি অনির্বাণ দীপশিখার মতো উজ্জ্বল। আজ তাঁর এই মৃত্যুদিবসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দল সংগঠনে আমাদের উভয়ের সংগ্রামের কথা ভাবতে যেয়ে আমি সবচেয়ে বেশি বেদনা বোধ করছি।

তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসক ও কায়েমি স্বার্থ চক্র কী সুপরিকল্পিত উপায়ে এ দেশের শিল্পসংস্কৃতি ও ভাষা-সাহিত্যের বিনাশ সাধন করতে চেয়েছিল, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে সবকিছু বিষময় করে তোলার চেষ্টা করেছিল, তা সকলেরই জানা। মানিক ভাই তাঁর লেখনীর সাহায্যে সে ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে সজাগ করে তুলেছিলেন এ দেশের মানুষকে। মানুষের যদি স্মৃতিবিভ্রম ঘটে না থাকে তাহলে সে-সব কাহিনী তাদের ভুলে যাবার কথা নয়। এ দেশে যখন মুখ ফুটে কথা বলার অধিকার ছিল না, যখন মানুষের হয়ে মানুষের কথা বলার এবং বিরোধীদলীয় চিন্তাভাবনা তুলে ধরার মতো কেউ ছিল না, তখন মানিক ভাই-ই তার লেখনীর সাহায্যে পালন করেছেন সে গুরুভার দায়িত্ব। আর সে দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে বিভিন্নবার বিচিত্ররকম দুর্ভোগ তাঁকে পোহাতে হয়েছে। মানিক ভাই যতবার জেলে গেছেন, শুধু-রাজনৈতিক কারণে একজন সাংবাদিক বা সংবাদপত্র সম্পাদকের তত দীর্ঘ কারাবরণের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

রাজনীতি সম্পর্কে মানিক ভাই’র ধারণা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন মানুষের অধিকারের বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। তখন মানিক ভাই’র মাঝে এ দেশ এবং দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা লক্ষ্য করেছি, তা আমাকে অভিভূত করেছে। মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা এবং অনুভূতির প্রখরতা এত সুগভীর ছিল যে, মানুষ কি চায়, কি ভাবে-সহজেই তিনি তা বুঝতে পারতেন এবং তা তুলে ধরতেন লেখনীর মাধ্যমে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের মার্শাল ল’ জারি হবার পর মানিক ভাইকে সামরিক আইনবলে আটক করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড।

বলাবাহুল্য, আমিও তখন জেলে। আমাকে রাখা হয়েছে একটি নির্জন সেলে। দিন-রাত্রির দীর্ঘ দুঃসহ প্রহর একা একা যাপন করি। এমন সময় খবর পেলাম মানিক ভাইকেও গ্রেপ্তার করে আমার পার্শ্ববর্তী কক্ষে আটক রাখা হয়েছে। দুই ভাই জেলের পাশাপাশি দু’কক্ষে থাকি। কিন্তু দেখা সাক্ষাৎ করার উপায় নেই। কারণ, কর্তৃপক্ষ কড়া নির্দেশ দিয়েছেন কোনক্রমেই যেন আমাদের মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ না ঘটে। অবশ্য, সে কড়া নির্দেশ সত্ত্বেও আমরা পরস্পরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার সুযোগ করে নিয়েছিলাম।

একদিন এমনি এক সাক্ষাৎকারকালে মানিক ভাই জানালেন, সরকার পক্ষ তাকে আপোষ করার অনুরোধ জানিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি বলেছেন? মানিক ভাই উত্তর দিলেন, ‘চৌদ্দ বছর জেল খাটতে হয় সেও কবুল। কিন্তু নীতির প্রশ্নে আপোষ চলে না, এ কথাই ওদের জানিয়ে দিয়েছি। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বললেন, আসলে কি জানেন, ওরা আপনার ওপরই আরও অত্যাচার চালাবে। কেননা, তাদের ধারণা আপনার ওপর বাংলার মানুষের অগাধ বিশ্বাস। তাই কোনক্রমে যদি আপনাকে শেষ করা যায়, তাহলে সব ঝামেলাই শেষ হয়ে যাবে। তারপর নিজেই আমাকে ভরসা দিয়ে বললেন, ‘অবশ্য এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। সফল আপনি হবেনই।’

আজ এই মর্মন্তুদ বিয়োগ ব্যথার দিনে মনে পড়ে এমনি আরও কত কথা, কত ছবি। ১৯৬২ সাল। শ্রদ্ধেয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে জেলে নেবার অল্প কয়দিন পর আমরা দু’ভাইও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছি। তবে সান্তনার কথা এই যে, এ যাত্রা দু’জনকে দুটি স্বতন্ত্র সেলে আটক করা হয়নি, রাখা হয় একই কক্ষে। ফলে পারস্পরিক মত-বিনিময়ের সুযোগ ঘটে।

দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রায় সর্বক্ষণ আলাপ-আলোচনা করি। সেই আলাপ-আলোচনার সময় নীতির প্রতি মানিক ভাই’র যে অবিচল আস্থা দেখতে পাই, সত্যি বলতে কি, তা আমাকেও যুগপৎ প্রভাবিত ও মোহিত করে। তাছাড়া আমার প্রতি মানিক ভাই’র ভালোবাসা ও আস্থা যে কত গভীর, তা যেন আমি তখন আরও স্পষ্টভাবে অনুভব করি। অথচ, অনেকেই জানতো না একথা।

জানতো না মানিক ভাই কত ভালোবাসতেন আমাকে। তাই ক্ষণিকের বিভ্রমের মতো যখন আমাদের মধ্যে মান-অভিমান দেখা দিয়েছে, তখন অনেকেই গেছেন নিজ নিজ উদ্দেশ্যে মানিক ভাইকে প্ররোচিত করতে। কিন্তু তাদের নিরাশ হতে হয়েছে।

আমার বিরুদ্ধে বলে মানিক ভাই’র প্রিয় হতে যারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক সম্মানী ব্যক্তিকেও মানিক ভাই সোজাসুজি ঘর থেকে বের করে দিতে দ্বিধা করেননি। সকলেই জানেন, আইয়ুবের শাসনামলে আমাকে বার বার কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ফলে, একসময় এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, ভয়ে বন্ধু-বান্ধবদেরও অনেকে আমার পরিবারের খোঁজ-খবর নিবার সাহস হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু কোন অবস্থাতেই যিনি ভয় পাননি এবং আমার অবর্তমানে আমার পরিবারের পেছনে পাহাড়ের মতো যেয়ে যিনি দাঁড়াতেন, তিনি হলেন মানিক ভাই। তাই আমার কারাজীবনকালে মানিক ভাই যদি বাইরে থেকেছেন, তাহলে পরিবার সম্পর্কে আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পেরেছি।

ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। শহীদ সাহেবের পরলোক গমনের পর আমার দৃষ্টিতে সবকিছু যখন অন্ধকারময় বোধ হচ্ছিল, তখন মানিক ভাই দিয়েছেন অসীম প্রেরণা ও সাহস। আজ এই মুক্ত বাংলায় বেঁচে থাকলে অনেক সাহায্যই তিনি করতে পারতেন।

অবশ্য, ইয়াহিয়া বাহিনী তাকে জীবিত রাখত কিনা সেটাও একটা কথা। কেননা, স্বাধীন দেশে বুদ্ধিজীবীর অভাব ঘটানোর জন্য যে সুপরিকল্পিতভাবে ওরা সিরাজ, শহীদ (শহীদুল্লাহ কায়সার) প্রমুখ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, তাতে মানিক ভাইকে ওরা জীবিত রাখত, মনে হয় না। আজ মানিক ভাই যদিও আমাদের চোখের সামনে নেই, তবু তিনি অমর। তার নীতি ও আদর্শের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন আবহমানকাল।
(সংক্ষেপিত)

দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার
মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সূত্র : বঙ্গবন্ধু কোষ

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper