সুদহার কমাতে চার দফায়ও ব্যর্থ
আবারও প্রতিশ্রুতি ব্যাংক মালিকদের
জাফর আহমদ
🕐 ১০:২৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৬, ২০১৯
সুদহার কমিয়ে আনা, খেলাপি ঋণ সহনীয় করার শর্তে পর পর চারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এজন্য তারা কয়েক দফায় আর্থিক ও নীতি সহায়তা নেয় সরকারের কাছে থেকে। চারবারই সুদ কমিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।
ব্যর্থ হয়েছে খেলাপি ঋণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতেও। সর্বশেষ বৈঠক করে সুদহার কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় গণমাধ্যম যেন ব্যাংক মালিকদের দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারী না বলে, অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে সে অনুরোধ করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দেশের ৬০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে মাত্র ১৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। তারা দাবি করে, ঋণ বিতরণে সুদহার ৯ শতাংশ ও আমানত সংগ্রহে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৬টি। আর বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৯টি। অথচ, আর্থিক খাতে বেসরকারি ব্যাংকের অবদান সর্বোচ্চ প্রায় ৮২ ভাগে উঠেছে।
এসব ব্যাংকের ওপর নির্ভর করছে, দেশের বিনিয়োগে ব্যাংকিং খাত কতটুকু সহায়তা করবে। কিন্তু, দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং এর বিপরীতে বারবার বিভিন্ন সুবিধা নিয়েও সুদহার কমানোর ক্ষেত্রে কার্যত কোনো প্রতিদান দিতে পারেনি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
ঋণ হার নয়-ছয় বাস্তবায়নে সরকারি আমানত সুবিধা নিয়েছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। আগে সরকারি আমানতের ৭৫ ভাগ নিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিতে পারত ২৫ ভাগ। সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনার শর্তে সরকারি আমানতের অর্ধেক রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিতে পারছে। পাশাপাশি সরকারের সরকারি আমানত রাখার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই ৬ শতাংশের ওপরে সুদ নিতে পারবে না- এ ব্যাপারে আইন করিয়ে নেয় বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে সাড়ে ৬ শতাংশ সিআরআর সংরক্ষণ করত। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে এক শতাংশ কমিয়ে এনে তা সাড়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এর ফলে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিনিয়োগযোগ্য বাড়তি প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আমানত পেয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত স্বল্পমেয়াদি রেপো পেত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এর সময় বৃদ্ধি করে। এক্ষেত্রেও আমানতের বাড়তি সুবিধা পায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ৩৯ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স দিতে হতো। ঋণ বিতরণে সুদহার কমানোর শর্তে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ কমিয়ে ৩৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয় করপোরেট ট্যাক্স।
এসব সুবিধা নিতে বেসরকারি ব্যাংকের মালিকরা প্রথমে গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে সুদহার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে প্রতিশ্রুতি দেয়, সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর করার। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এর ব্যানারে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকরা নিজেরা বৈঠক করে ২০১৮-১৯ অর্থবছর শুরু থেকে ঋণ বিতরণে সুদ হার এক অঙ্কের ঘরে এবং আমানত সংগ্রহে সুদহার ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে আরেক দফা প্রতিশ্রুতি দেয়। এর বিপরীতে প্রতিফলন হয়নি বা দেখা যায়নি। কিন্তু, সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম সুবিধা ঘরে তোলে তারা।
এরপর চলতি ২০১৯-২০ বছরের শুরুতে ব্যাংক ব্যাংকার্স সভা করে এমডিরা। সভায় তারা উল্টো সুর তোলে। তাদের মতে, দিনক্ষণ ঠিক করে সুদহার কমানো যায় না। এটা একটি বাজার নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। বাজার ঠিক করবে কখন সুদহার কমবে। তবে এ জন্য যে যে ইনপুট প্রয়োজন সরকার সেগুলো দিয়েছে বলে তারা স্বীকার করেন।
একই অনুষ্ঠান শেষে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘শুধু ঘোষণা দিয়ে নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে অনেক বিষয় আছে। বর্তমানে তারল্য সংকট অনেকটাই কেটে গেছে। আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমতে শুরু করেছে এবং রপ্তানি বাড়ছে। ফলে ডলার কিনতে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা পাচ্ছে ব্যাংক। সঞ্চয়পত্র কেনায় কঠোরতা আনা হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোতে আমানত বাড়বে। আগামী জুন প্রান্তিকে এ উদ্যোগের আরও কিছুটা বাস্তবায়ন এবং খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে।’
সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের চেয়ারম্যান ও এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। সেখানে অর্থমন্ত্রী সুদহার নয়-ছয় কার্যকর করার বিষয়টি মনে করিয়ে দেন। সেখানে ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডিদের পক্ষ থেকে আরেক দাবি তোলা হয়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণ করছে। মূলত বিদ্যুৎপ্লান্টসহ সরকারের বিভিন্ন ধরনের বড় প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ফলে তারল্য সংকটে পড়তে হচ্ছে। এ কারণে সুদ হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা সরকারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। এ জন্য নীতি সহায়তা চায় তারা। ব্যাংকগুলোকে যেন গণমাধ্যম ঢালাও লুটপাটকারী ও দুর্নীতিবাজ না বলে সেজন্যও অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে অনুরোধ করেন তারা।
সুদ কমিয়ে আনার এ সব চেষ্টাকে ব্যর্থ চেষ্টা বলে মনে করেন পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘সুদ কমিয়ে আনার জন্য অনাদায়ী ঋণ আদায়, ঋণ যাতে অনাদায়ী না হয় সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া ও সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমিয়ে আনতে হবে। সরকার এগুলো না করে সুদহার কমানোর যে ধরনের চেষ্টা করছে এগুলো নিরর্থক।’