ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ঘোস্ট রাইটাররা কি স্বত্ব পাবেন

রকিব হাসান
🕐 ৯:৪০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০৩, ২০১৯

শেখ আবদুল হাকিম এবং ইফতেখার আমিন মাসুদ রানার অনেক বই লিখেছিলেন। এখন বইয়ের স্বত্ব দাবি করেছেন। এ বিষয়ে কেসও করেছেন তারা। কেসের বিষয়ে বিস্তারিত না জানলেও আমি জানি, অতীতে দুজনেই কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে মাসুদ রানা লিখতেন। স্বত্ব দাবির বিষয়ে বলব-এটা আসলে হয় না। একজনের নামে লিখে আরেকজন স্বত্ব দাবি করেন কীভাবে! ৪১ বছর ধরে সেবা প্রকাশনী থেকে আমার বই বেরিয়েছে। আমি বেরিয়ে আসি ২০০২ সালে। পুরো বিষয়টাই বেশ গোলমেলে ও ক্যাচালের। এটা বিরাট ইতিহাস। অল্প কথায় ব্যাখ্যা করা যাবে না। এরা দাবি করছেন এক জিনিস, ওরা দাবি করছেন আরেক জিনিস, আমি দাবি করছি অন্যটা, সেবা বলছে আরেকটা! তবে সবার দাবিরই ভিত্তি আছে।

আমি চলে আসার পর থেকেও তিন গোয়েন্দা বেরুচ্ছে, শামসুদ্দীন নওয়াব লিখছেন। এ বিষয়ে মামলা-মোকদ্দমায় যাইনি। এখনো কিছু বলব না। ওদের ইচ্ছা, ওদের প্রেস-জোর করে ছেপে দিয়েছে। পুরো বিষয়টাই অবৈধ। কিন্তু পাঠক অন্ধ নয়, সব বোঝে। বিশেষ করে সেবার পাঠক যারা, প্রথম থেকেই তারা সব জানে, নাড়ি-নক্ষত্র বোঝে। এর মধ্যে শেখ আবদুল হাকিম ও ইফতেখার আমিনের বিষয়টা আমার মতে-তাদের রয়্যালিটি পাওয়া উচিত। আবার আরেকটা মতও আছে। যেহেতু কথা কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে তারা বই লিখেছেন (আমারটা ভিন্ন, স্বনামেই ছাপা হয়েছে), অন্যের নামে প্রকাশিত বইয়ের স্বত্ব দাবি করে কী লাভ? তবে স্বত্ব পাওয়া উচিত। যেহেতু বই ছাপা হচ্ছে, বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু অন্যের নামে লিখেছেন, এখন দাবি ধোপে টিকবে না। সেবা প্রকাশনীতে রয়্যালিটি নিয়ে দীর্ঘ ক্যাচাল আছে। আমি তো শুধু শুধু সেবা থেকে বেরিয়ে আসিনি। খোলাখুলি বলব না।

যখন তিন গোয়েন্দার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ২০০২-৩ সাল নাগাদ- আমি বেরিয়ে এসেছি। কেন এলাম, নিশ্চয়ই এটার মধ্যে ক্যাচাল আছে! কেন রকিব হাসানের বদলে শামসুদ্দীন নওয়াব লিখলেন এটার মধ্যেও প্যাঁচ আছে। এখানকার সবই প্যাঁচালো। বিষয়টা স্পষ্ট করতে হবে কাজী আনোয়ার হোসেনকে। কিন্তু এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না তিনি। কথা বলতে ইচ্ছুক নন, কিন্তু কেন! আমি তো ইচ্ছুক। কিছু পয়েন্ট বাদে সবই তো বলেছি খোলা কাগজকে।

আমার বিষয়টা এক কথায় বলি- সেবার সঙ্গে বনিবনা হয়নি। তাদের সঙ্গে বনিবনা হয়নি তিন গোয়েন্দা নিয়ে। অন্য কোনো বইয়ের কথা বলব না। সিদ্ধান্ত জানালাম, আর লিখব না। তখন সেবা থেকে বলা হলো- তাহলে আমরা অন্য কাউকে দিয়ে লেখাব। আমি বললাম, লেখান! কিন্তু কী করে লেখাবেন, সিরিজটা তো আমার! তখন বলা হলো- ক্রেডিট লাইনে লেখা আছে ‘প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত’। লেখালেখির শুরুর দিকটাতে বইয়ে এ কথা লেখা হয়েছে। আমি তখন কিছু বুঝতাম না। তখন বয়স ৩১-৩২ হবে। আইনের প্যাঁচগোছ ও কপিরাইট সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিল না। তারা লিখেই যাচ্ছিলেন- ‘প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত’। এখন আমি যদি আদালতে যাই- আদালত বলবেন, এতদিন ধরে লিখে আসছেন কোনো শব্দ করেননি এখন আসছেন কেন? আপনি তো একজন ম্যাচিউরড লোক; কারণ আপনি লেখক। সব বোঝেন।

আসলে স্বত্ব ও মালিকানার বিষয়টা আমি যে বুঝিনি এটা বলতে গেলে লজ্জা পাব। সুতরাং এটা নিয়ে ক্যাচাল বাধাইনি। পার্থক্য হচ্ছে- আমি আদালতে যাইনি, শেখ আবদুল হাকিম এবং ইফতেখার আমিন গিয়েছেন। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে সেবা প্রকাশনী বই প্রকাশ করে গেছে; আমার একটা ইগো আছে বলে প্রতিবাদ করিনি। একটা তিন গোয়েন্দা সৃষ্টি করতে পেরেছি, আরও ১০টা তিন গোয়েন্দা সৃষ্টি করতে পারব। আমি তিন গোয়েন্দার পেপারব্যাকের পচা কাগজ নিয়ে আর টানাহ্যাঁচড়া করব না। সেবা থেকে বেরিয়ে ‘কিশোর মুসা রবিন’ নামে নতুন তিন গোয়েন্দা লিখে ফেললাম। এটা গত বছরের বইমেলায় বেস্টসেলার ছিল।

আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হয়েছে। প্রথমা, কথাপ্রকাশ, অবসর, কাকলী, অনন্যার মতো বড় বড় প্রকাশনী আমার বই ছাপে। সেবা প্রকাশনীর পচা কাগজে তিন গোয়েন্দা ছাপার আগ্রহ নেই। আমার নাম সবাই জানে, সবাই বলে- আপনার বই পড়ে বড় হয়েছি। এটা বড় প্রাপ্তি।

সেবার বর্তমান যে ক্যাচাল- তাতে একবারই রয়্যালিটি দেওয়া হয়েছে। পরে আর দেওয়া হয়নি। ঘোস্ট রাইটার নামে একটা প্রজাতি আছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জায়গায় একজনের বই আরেকজন লেখেন। ঘোস্ট রাইটারের কোনো নাম থাকে না, স্বত্ব থাকে না। লেখক-প্রকাশক বোঝাপড়া অনুযায়ী এদের যত টাকা দিয়ে বিদায় করতে পারেন, তাতেই শেষ। লিখিত চুক্তিও থাকে না। শেখ আবদুল হাকিম ও ইফতেখার আমিন আসলে ঘোস্ট রাইটার। তারা লেখক তথা স্বত্ব দাবিও করতে পারেন না এক অর্থে। আবার করতে পারেন অন্য অর্থে। সেটা তখন আইনি পর্যায়ে গড়াবে। তারা মামলা করেছেন, এখনো মামলা চলছে। ফেসবুকে নানা কথা লেখা হয়, শুনি।

সেবার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। যেহেতু শুরুতে একটা ভুল করেছি ‘স্বত্বের’ ফেরে। এরপর ১৫৮টা বই লিখেছি। ভুলটা আমার চোখে পড়ল না কেন? তখন কোনো অ্যাকশন নিলাম না কেন, দোষটা নিশ্চয়ই আমার! বেরিয়ে আসার পরও আমার নামে ছাপা হয়েছে তিন গোয়েন্দার ১০টা বই। বলা হলো, কভার তো করা আছে, বই না ছাপলে সেবা লোকসানে পড়বে। আমি সম্মতি দিলাম। তারপর থেকে শামসুদ্দীন নওয়াব নামে ছাপা হচ্ছে তিন গোয়েন্দা। তারা ভাবলেন, রকিব হাসান নামে ১০টা বই ছেপে বিজ্ঞাপন করে এখন শামসুদ্দীন নওয়াব নামে লেখাল। কিন্তু তারপর তো ফ্লপ করে গেল!
১০টা বই রকিব হাসানের নামে ছাপার পর যদি আবার উল্টে যায় তার মানে এখানে একটা ডিগবাজি খাওয়া হলো! আমি জানি, তিন গোয়েন্দাকে মারতে যাচ্ছে। ওরা দাবি করছে তিন গোয়েন্দা ওদের, তাহলে মারুক! আমি সৃষ্টি করেছি, ওরা স্বীকারও করতে চায় না। একজনের বই আরেকজন লিখে ফেলল, এ ইতিহাস বোধহয় সেবা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও নেই।

গেমটা আমি খেলেছি- তিন গোয়েন্দাকে আমি তুলে দিয়েছি, এখন তোমরা এটাকে মারো। পাশাপাশি আমি আরেকটা তিন গোয়েন্দা সৃষ্টি করলাম। একই ঘরানায় গিয়ে চলে গেলাম হোয়াইট প্রিন্টে। কারণ আমার সেই আত্মবিশ্বাস ছিল। সে বইও পাঠক লুফে নিয়েছে। এখন শামসুদ্দীন নওয়াব লিখে ভরে ফেলুন তাতে আমার কিছু যায় আসে না। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মনে করি- আমি সফল। শেখ আবদুল হাকিম এবং ইফতেখার আমিনের মতো খেদ নেই। রাগ দুঃখ ক্ষোভ আক্রোশ অভিমান হতাশা কিছুই নেই আমার।

রকিব হাসান : লেখক
তিন গোয়েন্দা সিরিজ

 
Electronic Paper