এখনো আকাশ বেয়ে শ্রাবণধারা নামে
শামস্ আল্দীন
🕐 ১২:২০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০২, ২০১৯
কবিতার ছন্দে ভর করে চলাটা যেন আমাদের সংস্কৃতির নিয়ম। অনেক কাল আগে থেকেই আকাশ বৃষ্টি দৃষ্টি দিয়েছে আমাদের সাহিত্য। ভাবালুতা যেন আমাদের নিত্যদিনের জীবন বোধ। সন্ধ্যা পারের ঝুম বৃষ্টি আজও ছেদ চিহ্নে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের। কত প্রতীক্ষার ও তৃষ্ণার অবসান ঘটে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়া আহ্লাদ। নতুন রূপে প্রাণ পায় ফিরে যৌবনে জাগ্রত হয় শস্য-শ্যামল প্রকৃতি। বর্ষার কথা বলছি। সব জীবন বোধের কোষগুলো ফিরে আসে বারবার তোমার আগমনে।
আজকাল বড্ড রকমের আনমনে আচমকা অপ্রস্তুত হয়ে যায়, যেন কেউ এসে জাগিয়ে দেয়। স্বপ্নকারিগর হয়ে ওঠা বর্ষা তেমন করেই আমাদের সুস্থ বাসনাকে নাড়িয়ে দেয়। বাঁচার রসদ হয়ে ফিরে আসে। দিনের শেষান্তে যেন অবিরাম বাঁচার জন্য লড়াই করে। গাছের পাতায় জমে থাকা বৃষ্টি ফোঁটা সোনা রঙে আবির মাথায় সোনালি সকালে। নতুন প্রেমের সম্ভাবনা দুয়ার খোলে এক পলকে। আমরা সম্ভাবনায় বাঁচি প্রতিদিন। বৃষ্টি ছড়ানো পিচ্ছিল পথে আলতো করে পা ফেলি। রোদ ঝলকে চমকে উঠি। ভালোবাসায় প্রাণ ফিরে পায়। বর্ষাকালে আমরা বাঁচি নানা প্রত্যাশায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিন্নপত্রের আট নং চিঠিতে বর্ষাকে ঘিরে বলেছেন, ‘আজকাল এখানে বর্ষা পড়েছে। ঘন মেঘ ও অবিরাম বৃষ্টি। এই সময়ই তো বন্ধু সংগমের সময়। এই সময়টা ইচ্ছা করছে, তাকিয়ে আশ্রয় করে পড়ে পড়ে যা- তা বকাবকি করি। বাইরে কেবল ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি, ঝন্ ঝন্ বজ্র, হু হু বাতাস....।’ চমৎকার বর্ণনা।
এমনভাবেই আমাদের পাল্টে দেয় বর্ষা। অসংখ্য ক্লেশ থেকে আমাদের মুক্তি মেলে। হঠাৎ করেই হারিয়ে যেত নেই কোনো মানা। প্রকৃতি দেবী যেন ফিরে পায় তার চেহারা। নতুন করে রঙ ছড়ায় প্রতি শাখে। শহরের অট্টালিকা সমপ্রাসাদের বারান্দা বাগানের গাছ-ফুলে যেন তারার মেলা দেখা যায়। ঘনায়মান আকাশ জ্যোৎস্না সাত রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। পথ চলতি মানুষগুলোর চোখে উদ্বিগ্নতার লেশমাত্র দেখা যায় না। চঞ্চলতা ও স্নিগ্ধতা যেন তার নিত্যসঙ্গী। এমনই নিয়ত ও অবিরত আষাঢ় ভেলায় আমাদের ভেসে চলা। যেন ‘বেলা যে পড়ে এলো জলকে চল।’ আমাদের জীবন পরিবর্তনে অনেকগুলো স্বপ্ন ও প্রত্যাশা বাঁচতে শেখায়। ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বসন্তকে ঋতুর রাজা বলা হলেও প্রাণোচ্ছ্বল উন্মাদনা বর্ষাতেই পরিলক্ষিত হয়। যেন মন ভেজে বাঁচার আকুতিতে।
বর্ষা আসার অপেক্ষায় থাকা কৃষক নতুন করে স্বপ্ন বোনে অন্তরে। মাঠে-ঘাটে ভেজাজীবনে যেন প্রাণ ফেরে। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় উছলে ওঠে বর্ষার আগমনে। মাছের আনন্দ লাফ জীবন বৈচিত্র্যের আরেক সৌন্দর্য-স্বপ্ন। আমাদের কৃষক সমাজ ফসলের মাঠে ফিরে পায় নিজেকে। শরীর পায় শান্তির পেলবতা। পাটের আঁশ ছাড়ানোর সে কি মনোহর দৃশ্য। কৃষকের মাঠে লাঙ্গল চালানো গরুর জোয়ালে ভর করে ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই’ গানের মাঝে হারিয়ে যাওয়া। আমরা যেন স্বপ্ন বুনি আষাঢ় শ্রাবণে। বন্ধুর আত্মা যেন বন্ধুকে খুঁজে ফেরে বারবার। এ সবই বর্ষাতেই সম্ভব। শক্তি হীন প্রাণ যেন শক্তি ফিরে পায় অন্তরে। অব্যক্ত কথামালা প্রিয়জনে ঠাঁই খোঁজে। নতুন সংসারে বন্ধু যেন লাল পেড়ে শাড়িতে উচ্ছ্বাস ফিরে পায়। গ্রাম্য মেঠো পথের কিনারে পানিভর্তি বিস্তীর্ণ মাঠ ভাসায় পাশের গ্রাম-পাড়া-মহল্লা। তবুও যেন কোনো এক অদৃশ্য তৃপ্তি ঘিরে থাকে অন্তরে। সমাজ সংস্কৃতির নিয়ম যায় পাল্টে। উচ্ছল মুখের চাহনিই বলে দেয় নিত্যদিনের চলার পথ। এসবই বর্ষাকে ঘিরে আবর্তিত। পুকুর ধারে গ্রাম্য শিশুর উপদ্রব আর কলা গাছের ভেলা নৌকায় ভেসে চলা প্রাপ্তিই যেন বর্ষা।
সাহিত্যের প্রতিটি শাখাতেই বর্ষার গান, কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও নাটক রচিত হয়েছে। আমরা বর্ষাবরণ উৎসব ও বিভিন্নভাবে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকি।
এ আয়োজনে শুধু মানসিক খোরাক না আত্মিক টান ও অনুভবও বটে। জীবনের জল ছবিতে কত না চিত্রই অঙ্কিত হয়, খেয়ালে-বেখেয়ালে আয়েশী চিত্তে আমরা তা লালন করে থাকে। বাঙালি চিরকালই উৎসব ও আনন্দ প্রিয়। যে কোনো কিছুতেই আয়োজন ও আনন্দের মাধ্যম খোঁজে। শিল্প ও সংস্কৃতির আয়োজনে ছয় ঋতুই সমান গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। এই মানসিক উন্নয়ন ও চিন্তা আমাদের দিয়েছে বৈচিত্র্য।
সর্বোপরি জীবনপথের সব উপাদানে যদি আমরা আলোর সন্ধান করি অবশ্যই সফল হবো। এমনই বিষয়ের তাৎপর্যে বর্ষা আমাদের অনুভূতির আরেক স্পর্শ, যা চিরন্তন ও নতুনত্বে আলোকজ্জ্বল।