ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রবীন্দ্রনাথের নীরব বেদনা

নীপা কর
🕐 ১২:১৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০২, ২০১৯

বোবা মেয়ের করুণ জীবনকাহিনী। তবে তা নিয়ে আতিশয্য নেই, সংযত সংযমে ব্যক্ত। বাক্যহীন শুভার মধ্য দিয়ে বিশাল বাক্যহীন নিঃসর্গ প্রকৃতির সঙ্গে মানবপ্রকৃতির নিগুঢ় আত্মীয়তা আবিষ্কারের প্রয়াস গল্পটিতে লক্ষণীয়।‘শুভার কথা ছিল না, কিন্তু তাহার সুদীর্ঘ পল্লববিশিষ্ট বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ ছিল এবং তাহার ওষ্ঠাধর ভাবের আভাসমাত্রে কচি কিশলয়ের মতো কাঁপিয়া উঠিত। কথায় কথায় আমরা যে ভাব প্রকাশ করি সেটা আমাদিগকে অনেকটা নিজের চেষ্টায় গড়িয়া লইতে হয়, কতকটা তর্জমা করার মতো; সকল সময়ে ঠিক হয় না, ক্ষমতা অভাবে অনেক সময়ে ভুলও হয়। কিন্তু কালো চোখকে কিছু তর্জমা করিতে হয় না- মন আপনি তাহার উপরে ছায়া ফেলে; ভাব আপনি তাহার উপরে কখনো প্রসারিত কখনো মুদিত হয়; কখনো উজ্জ্বলভাবে জ্বলিয়া ওঠে, কখনো স্নানভাবে নিবিয়া আসে, কখনো অস্তমান চন্দ্রের মতো অনিমেষভাবে চাহিয়া থাকে, কখনো স্রোত চঞ্চল বিদাতের মতো দিগি দিকে ঠিকরিয়া ওঠে।

মুখের ভাব বৈ আজন্মকাল যাহার অন্য ভাষা নেই তাহার চোখের ভাষা অসীম উদার এবং অতলস্পর্শ গভীর অনেকটা স্বচ্ছ আকাশের মতো, উদয়াস্ত এবং ছায়ালোকে নিস্তব্ধ রঙ্গভূমি। এই বাক্যহীন মনুষের মধ্যে বৃহৎ প্রকৃতির মতো একটা বিজন মহত্ত্ব আছে। ....সে নির্জন দ্বিপ্রহরের মতো শব্দহীন এবং সঙ্গীহীন।... প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়। নদীর কলধ্বনি, লোকের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর- সমস্ত মিশিয়া চারদিকের চলাফেরা-আন্দোলন-কম্পনের সহিত এক হইয়া সমুদ্রের তরঙ্গরাশির ন্যায় বালিকার চিরনিস্তব্ধ হৃদয়-উপকূলের নিকটে আসিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে।

প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এবং বিচিত্র গতি, ইহাও বোবার ভাষা বড়ো বড়ো চক্ষু পল্লববিশিষ্ট শুভার যে ভাষা তাহারই একটা বিশ্বব্যাপী বিস্তার, ঝিল্লি রবপূর্ণ তৃণভূমি হইতে শব্দাতীত নক্ষত্রলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত, ভক্তি, সংগীত, ক্রন্দন এবং দীর্ঘনিশ্বাস। ‘প্রকৃতির মধ্যে যে বিচিত্র ভাষাহীনতার খেলা সর্বদাই চলছে শুভার সঙ্গে তাকে একাত্ম করে দিয়েছেন গল্পকার।

গল্পটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের বোবা মেয়ের জন্য যে বঞ্চনা নির্দিষ্ট হয়ে থাকে গল্পকার তাকেই গল্পে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ফলে প্রতাপের সঙ্গে শুভার সম্পর্ক নিয়ে কোনো বাড়তি কৌতূহলের সৃষ্টি করেননি।

শুভার শ্রবণেন্দ্রিয় অনুভূতিহীন হলেও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর-মন অনুভূতিপ্রবণ হয়ে উঠেছে। যৌবনচেতনা তথা যৌন চেতনা জীবনের স্বাভাবিক ধর্মে জাগরিত হয়ে উঠেছে। ‘শুভার বয়স ক্রমেই বাড়িয়া উঠিতেছে। ক্রমে সে যেন আপনাকে আপনি অনুভব করিতে পারিতেছে। যেন কোনো-একটা পূর্ণিমাতিথিতে কোনো-একটা সমুদ্র হইতে একটা জোয়ারের স্রোত আসিয়া তাহার অন্তরাত্মাকে এক নূতন অনির্বচনীয় চেতনাশক্তিতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতেছে। সে আপনাকে আপনি দেখিতেছে, ভাবিতেছে, প্রশ্ন করিতেছে এবং বুঝিতে পারিতেছে না। গভীর পূর্ণিমারাত্রে সে এক-একদিন ধীরে শয়নগৃহের দ্বার খুলিয়া ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়াইয়া বাইরের দিকে চাহিয়া দেখে, পূর্ণিমাপ্রকৃতিও শুভার মতো একাকিনী সুপ্ত জগতের উপর জাগিয়া বসিয়া- যৌবনের রহস্যে পুলকে বিষাদে অসীম নির্জনতার একেবারে শেষ সীমা পর্যন্ত, এমনকি তাহা অতিক্রম করিয়াও থমথম করিতেছে, একটি কথা কহিতে পারিতেছে না। এই নিস্তব্ধ ব্যাকুল প্রকৃতির প্রান্তে একটি নিস্তব্ধ ব্যাকুল বালিকা দাঁড়াইয়া’।

অস্ফুট হলেও এই যৌনচেতা অনুভূতিগ্রাহ্য। যৌবনের উন্মেষে প্রবৃত্তির জাগরণ যেমন তার মধ্যে ঘটেছে তেমনি প্রতাপকে কেন্দ্র করে তার মানসিক অনুভূতি গড়ে উঠেছে, যদিও তাকে ঠিক হৃদয়ানুরাগ বলে চিহ্নিত করা যায় না বা শুভা নিজেও ঠিক এই হৃদয় দৌর্বল্যের সম্যক অনুভব করতে পারেনি। সকলেই শুভকে শুভা বলিত, প্রতাপ আর-একটু অতিরিক্ত আদর সংযোগ করিয়া শুভকে শু বলিত। শুভা তেঁতুলতলায় বসিয়া থাকিত এবং প্রতাপ অনতিদূরে মাটিতে ছিপ ফেলিয়া জলের দিকে চাহিয়া থাকিত। প্রতাপের একটি করিয়া পান বরাদ্দ ছিল, শুভা তাহা নিজে সাজিয়া আনিত এবং বোধ করি অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া চাহিয়া চাহিয়া ইচ্ছা করিত, প্রতাপের কোনো-একটা বিশেষ সাহায্য করিতে, একটা কোনো কাজে লাগিতে, কোনোমতে জানাইয়া দিতে যে, এই পৃথিবীতে সেও একজন কম প্রয়োজনীয় লোক নহে। কিন্তু কিছুই করিবার ছিল না। তখন সে মনে মনে বিধাতার কাছে অলৌকিক ক্ষমতা প্রার্থনা করিত- মন্ত্রবলে সহসা এমন একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটাইতে ইচ্ছা করিত যাহা দেখিয়া প্রতাপ আশ্চর্য হইয়া যাইত, বলিত ‘তাই তো; আমাদের শুভির যে এত ক্ষমতা তাহা তো জানিতাম না।’

গল্পের সমাপ্তিতে শুভার করুণ পরিণতি অবশ্যম্ভাবী ছিল, পাঠককে তা বিস্মিত করে না। বোবা মেয়ের বেদনাবিধুর জীবনকাহিনী বাস্তবতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন তবে তার মধ্য দিয়ে বাক্যহীন নারী শুভার অন্তরসঞ্চারী যৌবনচেতনা ও অপ্রকাশিত হৃদয়াবেগ এবং অব্যক্ত বেদনা পাঠককে কিছুটা নাড়া দিয়ে যায়।

 
Electronic Paper