ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জন্ম শতবর্ষের আলোয় সঞ্জীব দত্ত

সাজ্জাদ কাদির
🕐 ৯:৩২ অপরাহ্ণ, জুলাই ৩১, ২০১৯

আমাদের মহান ভাষা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান ও একই সঙ্গে রক্তের ঋণ রয়েছে যাদের তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার পরিবারের কথা। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই প্রথম ব্যক্তি যিনি পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি উত্থাপন করেছিলেন।

তার সমগ্র জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করেছেন; শিকড় ঘেঁষা মানুষের রাজনীতি করেছেন এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ কুমিল্লার বাড়ি থেকে পাকিস্তান আর্মি তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর সীমহীন অত্যাচারে ১৪ এপ্রিল দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কনিষ্ঠ পুত্র রাহুল দত্তকে সঙ্গে নিয়ে ৮৪ বছর বয়সে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন।

আর এই পরিবারেই ১৯১৯ সালের ১০ জুলাই জন্ম নিয়েছিলেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্র সন্তানসঞ্জীব দত্ত। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-সুরবালা দত্ত দম্পতির সাত কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের মধ্যে সঞ্জীব ছিলেন দ্বিতীয়। তার পারিবারিক ডাক নাম ছিল ক্ষেপু।

সঞ্জীব দত্ত ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালা থেকে গণিতে ডিস্টিংশনসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।

ছেলেবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী সঞ্জীব গণিতে ডিস্টিংশন পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন বড় হয়ে একজন গণিতবিদ হবেন। ভর্তি হন কলকাতার রিপন কলেজে। সেখান থেকে ১৯৩৭ সালে আইএসসি এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে বিএসসি পাস করেন। পড়াশোনায় দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেন।

ছেলেবেলায় স্বপ্ন দেখলেও শেষ পর্যন্ত তিনি গণিতবিদ হতে পারেননি। বড় হতে হতে তার চিন্তা-চেতনা নানা বিষয় বৈচিত্র্যে ডালপালা মেলতে থাকে। আগ্রহের জায়গা তৈরি হয় ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতিবিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে। তিনি বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেন। তার জ্ঞানের পিপাসা ছিল অফুরন্ত।

স্কুল জীবনে কুমিল্লায় থাকা অবস্থায় নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে মঞ্চে অভিনয় ও নির্দেশনা ছিল একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। ওই সময়ে শেকসপিয়রের লেখা বেশ কিছু ইংরেজি সাহিত্যের কালজয়ী নাটক ইংরেজি ভাষাতেই তার নির্দেশনা ও অভিনয়ে মঞ্চস্থ হয়। তার তারুণ্য এবং যৌবনের সোনালি দিনগুলো গেছে উপমহাদেশের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়ে। যার কারণে এই অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তার সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনকে বারবার ব্যাহত করেছে। তা ছাড়া তার স্বভাবও ছিল খানিকটা বোহেমিয়ান টাইপের। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ব্যবসায়ী হিসেবে। এ ছাড়া শিক্ষকতা, সরকারি-বেসরকারি চাকরিসহ অনেক বিচিত্র পেশায় তিনি বিচরণ করেছেন। কর্ম জীবনে তিনি এই পেশাগুলোতেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন।

কিংবা পিতার মতো একজন রাজনীতিবিদও হতে পারতেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই তার মন বসেনি। নাম যেমন ক্ষেপু, স্বভাবেও খানিকটা তেমনই ছিলেন।

সঞ্জীব দত্ত ১৯৫৩ সালে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। সাংবাদিকতা পেশা শুরু করেন ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারে। যেন এমন একটি কর্মই তার কাক্সিক্ষত ছিল। এখানে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটতে থাকে।

ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন একজন বর্ষীয়ান সাংবাদিক হিসেবে। একই সঙ্গে তিনি নিজেকে দাঁড় করান একজন শিল্প সমালোচক, অভিনেতা, কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও সাময়িকী সম্পাদক হিসেবে। অত্যন্ত সুদর্শন সঞ্জীব দত্ত এই সময় সালাউদ্দিন পরিচালিত যে নদী মরুপথে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

চলচ্চিত্রটি ১৯৬১ সালে মুক্তি পায়। তার অভিনীত জহির রায়হান পরিচালিত কখনো আসেনি চলচ্চিত্রটিও একই বছর মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রেও তাকে অত্যন্ত বলিষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায়। সৃজনশীল দুনিয়ায় কাজ করাটাই ছিল তার জীবনের উজ্জ্বলতম সময়।

১৯৬২ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে তিনি আবার স্বেচ্ছা নির্বাসনে কলকাতা চলে যান। অমৃতবাজার ও স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখালেখি করেন। ১৯৬৫ সালে ত্রৈমাসিক ইংরেজি সাহিত্য পত্রিকা লিভ্যান্টতার সম্পাদনায় বের হয়। এক সময় অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদকও হয়েছিলেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

সঞ্জীব দত্ত ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কদিন আগে সঞ্জীব দত্তের শততম জন্মদিনের এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও তাকে কাছ থেকে দেখা সাবেক মন্ত্রী এম সাইদুজ্জামানের বক্তব্য থেকে জানা যায়, দেশে ফিরলে বঙ্গবন্ধু তাকে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত করে পাঠাতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু তার মেয়ে আরমা দত্ত ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকায় মেয়ের পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এতে করে পরিবার এবং সন্তানের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধেরও পরিচয় পাওয়া যায়। পরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সহকারী সম্পাদক হিসেবে আবারও বাংলাদেশ অবজারভারে যোগদান করেন। ১৯৭৫ পর্যন্ত এখানেই ছিলেন। প্রায় ৪০ বছর তিনি নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে শহীদ হলে নিদারুণ মনোকষ্ট নিয়ে পুনরায় কলকাতায় স্বেচ্ছানির্বাসনে পাড়ি জমান। এরপর আর কখনো দেশে ফিরে আসেননি।

সঞ্জীব দত্তের সাংবাদিকতা ও সাহিত্য কর্মের ভাষা ছিল ইংরেজি। অত্যন্ত উঁচুমানের হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে পারেননি বলে মনে করা হয়। তার সাহিত্যকর্মের খুব সামান্য অংশই গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বিপুল অংশ রয়ে গেছে অগ্রন্থিত অবস্থায়। যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, খাতা ও ডায়রিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা মাত্র তিনটি। আশার কথা হলো কদিন আগে তার জন্মদিনের এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে কন্যা আরমা দত্তের বক্তব্য থেকে জানা যায়, কমপক্ষে দুটি পাণ্ডুলিপি তার সংগ্রহে আছে। যেগুলো তিনি প্রকাশের উদ্যোগ নেবেন। এ ছাড়া আরও যেসব সাহিত্য কর্ম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলে আগামী প্রজন্ম সঞ্জীব দত্তকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবে।

ব্যক্তিগত জীবনে সঞ্জীব দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৯ আগস্ট কলকাতার বালিগঞ্জের ঘটক বাড়ির কন্য প্রতীতি ঘটকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সঞ্জীব দত্তের মতো প্রতীতিও উপমহাদেশের এক বিখ্যাত পরিবারের সন্তান। প্রতীতির বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক ছিলেন আইসিএস কর্মকর্তা। পৈতৃক বাড়ি পাবনা জেলায়। পরিবারটি ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অত্যন্ত উঁচুমানের। সুরেশ ঘটকের প্রতিটি সন্তান ছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত উজ্জ্বল।

প্রথম সন্তান মনীশ ঘটক ছিলেন খ্যাতিমান কবি ও কথা সাহিত্যিক। তারই সুযোগ্য কন্যা মহাশ্বেতা দেবী। যিনি একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কথা সাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলন কর্মী ছিলেন। প্রতীতি দেবীর যমজ ভাই বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও লেখক ঋত্বিক ঘটক। যার খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। সঞ্জীব-প্রতীতি দম্পতির এক কন্যা ও এক পুত্র। কন্যা আরমা দত্ত একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছেন এবং পরবর্তীতে বেসরকারি উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে চলেছেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। পুত্র রাহুল দত্ত জন্ম থেকেই মানসিক প্রতিবন্ধী।

সঞ্জীব দত্ত ১৯৭১ সালে কলকাতায় ছিলেন। দেশে থাকলে হয়তো তারও পরিণতি হতে পারত পিতা এবং ছোট ভাইয়ের মতো। নিয়তি তাকে সে যাত্রায় প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মৃত্যু যে অনিবার্য সত্য।

আর তিনি এই সত্যের মুখোমুখি হন ৭২ বছর বয়সে ১৯৯২ সালের ২৭ এপ্রিল কলকাতার ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার মাধ্যমে। অবসান হয় এক বহুমুখী প্রতিভাধর জীবনের।

গত ১০ জুলাই সঞ্জীব দত্তের শততম জন্মদিন নীরবেই চলে গেল। তার জন্মভূমির কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা তাকে মনে রখেছে বলে চোখে পড়েনি। কারণ এই দিন তাকে স্মরণ করে কেন আয়োজন হতে দেখা যায়নি।

ব্যক্তি জীবনে বড় অভিমানি এই বিরল প্রতিভাধর মানুষটির জীবন আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে এক বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে যদি আমরা তার জীবন ও কর্ম যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারি।

আমরা আশা করব, ভবিষ্যতে তার পরিবার, বন্ধু, স্বজন তার কর্মকে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। তার জন্মশতবর্ষে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সাজ্জাদ কাদির : লেখক, কলামিস্ট, টেলিভিশন
ব্যক্তিত্ব ও তথ্যচিত্র নির্মাতা
[email protected]

 
Electronic Paper