ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হুজুগে বাঙালির গুজবে বিশ্বাস!

শরীফা উম্মে শিরিন
🕐 ৯:৫৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৪, ২০১৯

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গণপিটুনির শিকার একজন মায়ের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। গত ২০ জুলাই ২০১৯ তারিখে চার বছরের সন্তান তুবাকে ভর্তির জন্য রাজধানীর বাড্ডার একটি স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন তাসলিমা বেগম রেণু। কিন্তু ফিরলেন লাশ হয়ে। তুবা’কে আর স্কুলে ভর্তি করাতে পারলেন না রেণু। ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে মুহূর্তেই ঝরে গেল একজন মায়ের প্রাণ। এ ঘটনাসহ ‘ছেলেধরা’ গুজবে গণপিটুনির সংবাদ, প্রিয়া সাহার নির্জলা মিথ্যা বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মাথা লাগবে’-এমন গুজবে সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এ গুজবে ২১ জুলাই পর্যন্ত ৯ জেলায় অন্তত ১৯ জন গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। মারা গেছেন ৯ জন।

গত ১৮ জুলাই নেত্রকোনায় ব্যাগে করে এক শিশুর ছিন্ন মাথা নিয়ে পালানোর সময় মাদকাসক্ত এক যুবককে (২৮) ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যা করে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ ঘটনার পর থেকেই ‘ছেলেধরা’ গুজবে গণপিটুনির খবর আসতে থাকে সারা দেশ থেকে। অনাকাক্সিক্ষত গণপিটুনিতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নারী যারা রাস্তা-ঘাটে, শপিং মলে বাচ্চা দেখলে আদর করে তারাও আতঙ্কগ্রস্ত বলে নিজেদের মতপ্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কেউ কেউ লিখছেন, ‘আমাকে মারতে চাইলে ছেলেধরা বলে চিৎকার দাও’।

বাস্তবে মানুষ এই ‘ছেলেধরা’ গুজবকে কাজে লাগিয়ে পূর্ব শত্রুকে হত্যাসহ মারধর করছে। নওগাঁর মান্দায় ছেলেধরা গুজব রটিয়ে ছয় জেলেকে মারধর করেছে (২২ জুলাই, প্রথম আলো)। ২০ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মিজমিজিতে গলাকাটা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হন বাকপ্রতিবন্ধী মো. সিরাজ। কিন্তু পরিবারের অভিযোগ, নিজের মেয়েকে দেখতে গেলে সাবেক স্ত্রী ‘গলাকাটা’ গুজব রটিয়ে সিরাজকে হত্যা করান। কি ভয়ঙ্কর সংবাদ!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যম এখন গুজবের প্রতিক্রিয়ায় সরগরম। কিন্তু গুজব কীভাবে রোধ করা যায় সেটাই কোটি টাকার প্রশ্ন? প্রবাদে আছে, গুজব বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ কিংবা উপমহাদেশে ‘গুজব’ বা ‘গণপিটুনি’ নতুন ধারণা নয়। যুগ যুগ ধরে কুসংস্কারাছন্ন জাতির মস্তিষ্কে এ ধারণা বিরাজ করছে। গুজবে বিশ্বাসী হুজুগে বাঙালির কর্মকাণ্ড নিয়ে বহু আগে থেকেই এদেশে সাহিত্য রচিত হয়েছে।

প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’তে ‘মোদাব্বের’ নামক হুজুগে বাঙালি চরিত্র এবং নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় ‘কান নিয়েছে চিলে’-এ কথা শুনে চিলের পেছনে পেছনে দৌড়ানো বাঙালির ইতিহাস পুরনো। বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার বাড়লেও ‘কুসংস্কার’ কিংবা ‘গুজব’ থেকে মুক্তি পায়নি বাঙালি। তাই ‘গণপিটুনি’র মতো ভয়াবহ অপসংস্কৃতিতেও পশুত্ব আনন্দ পাচ্ছে তারা।

কয়েকদিন আগে ফেসবুকে এক ব্যক্তি গুজবকে ব্যঙ্গ করে পোস্ট দিয়েছে, ‘চাইনিজরা বলেছে, We need more heads. তাতেই ‘পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে’-এমন গুজব সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকটা প্রচলিত ‘রানীর কালো ছেলে কাক হয়ে যাওয়ার’ পুরনো প্রবাদের মতো। শুধু ছেলেধরা গুজবে নয়; ছিনতাই, চোর সন্দেহেও দেশে পণপিটুনির অপসংস্কৃতি বাড়ছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে এ বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) সারা দেশে ৩৬ জন গণপিটুনিতে মারা গেছেন (২২ জুলাই, ২০১৯, প্রথম আলো)। বার্ষিক হিসাবে এ হার ভয়াবহ। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ভয়াবহভাবে গণপিটুনির সংখ্যা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে তা আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। গত ২৫ জুন তাবরেজ আনসারিকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করার জন্য গণপিটুনির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও ‘জয় শ্রীরাম’ বলেও শেষ রক্ষা হয়নি তাবরেজের।

মোদি সরকারের আমলে ২০১৪ থেকে ২৫ জুন ২০১৯ পর্যন্ত ভারতে তাবরেজসহ মোট ২৬৬ জন গণপিটুনিতে মারা যায়। আসলে ১৩৭ কোটি মানুষের দেশ ভারতে ২৬৬ জন নগণ্য বা কিছু সংখ্যা মাত্র! তেমনি ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে ছয় মাসে মাত্র ৩৬ জনের মৃত্যুতে কি আসে যায়! আজকের সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত ইউরোপ, আমেরিকাও কিন্তু গণপিটুনির সংস্কৃতি থেকে মুক্ত ছিল না। ১৮৮২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় প্রায় ৪ হাজার ৭৪২ জন মব লিনচিংয়ের শিকার হয়েছে। বর্তমানে সেখানের চিত্র ভিন্ন। কিন্তু সভ্যতার এ যুগে এসে বিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে এ উপমহাদেশে ‘গণপিটুনি’ বা ‘গণধোলাই’ কিংবা ‘মব লিনচিং’- এর সংখ্যা বাড়ছে কেন?

বাংলাদেশেও যেখানে সবক্ষেত্রেই উন্নয়নের জোয়ার বইছে, তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, দারিদ্র্যেও হার কমছে, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটছে, মানুষের আয়ু বাড়ছে, সেখানে মানুষ কেন এত অসহিষ্ণু হচ্ছে, গুজবের বিস্তার বাড়ছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিচার-বহির্ভূত গণপিটুনিতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা; সেটাই ভাববার বিষয়!
গণপিটুনির অন্যতম প্রধান কারণ আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা। জনগণের ধারণা, আইনের অধীনে আনা হলেও অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, বিচারে তাদের দৃশ্যমান কোনো শাস্তি হয় না। বিচার ব্যবস্থার প্রতি এ আস্থাহীনতার যথেষ্ট উদাহরণও আছে দেশে। যেমন, নুসরাত হত্যাকাণ্ডে অপরাধীদের গ্রেফতারে তালবাহানা, ত্বকী, তনু, খাদিজা, সাগর-রুনি ইত্যাদি হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়া।

অন্যদিকে দেশে আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন না থাকা গণপিটুনিকে উৎসাহিত করছে। যেমন, প্রকাশ্যে কুপিয়ে বিশ্বজিৎ, সম্প্রতি রিফাত হত্যাকাণ্ডে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীদের গ্রেফতারে ব্যর্থতা। এমনকি বিচারকের এজলাসে বিচার চলাকালীন বিচারকের টেবিলে ফেলে ছুরিকাঘাতে যখন এক আসামি আরেক আসামিকে হত্যা করে তখন স্বাভাবিকভাবে বুঝতে বাকি থাকে না যে আমরা কোথাও নিরাপদ নয়। গত ১৫ জুলাই কুমিল্লার এক আদালতে এ ধরনের ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে।

এ ছাড়া সমাজে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ও গণপিটুনিকে উসকে দিতে ভূমিকা রাখে। সম্প্রতি মাদক নিধন অভিযানের সময় ক্রসফায়ারে অপরাধীর পাশাপাশি নিরপরাধ ব্যক্তিও মারা গেছেন।

২০১৮ সালের ২৬ মে র‌্যাব ভুল করে কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হককে হত্যা করে। সম্প্রতি আলোচিত বরগুনার রিফাত হত্যার মূল অপরাধী নয়ন বন্ডকেও কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়। এতে একদিকে যেমন নিরপরাধ ব্যক্তির মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে অন্যদিকে হত্যার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় না। পুলিশের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব, ভয়ের সম্পর্ক ও তাদের প্রতি অবিশ্বাসও গণপিটুনির অন্যতম কারণ। এ কারণেও তারা অপরাধী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে স্থানীয় পুলিশের হাতে না দিয়ে গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যা করে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পিছপা হচ্ছে না। অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও কুসংস্কারে বিশ্বাসের জন্যও গণপিটুনির মতো অপরাধ বাড়ছে। গণপিটুনি এখন ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে।

দেশে ক্রমাগত বিরাজমান গুম, প্রকাশ্যে হত্যা, জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা, ক্রসফায়ার, গণপিটুনি, অহরহ সড়ক দুর্ঘটনা সামাজিক নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে। মানুষ এখন নন্দলালের মতো বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছে। ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ক্লাসে মজা করে বলেছিলেন, ‘এখন মারা যাওয়াটা নিউজ না, বেঁচে ঘরে ফেরাটাই নিউজ।’ আমরা নন্দলালের মতো হতে চাই না। ঘরে-বাইরে এমনকি সারা দেশে প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। সরকারকে গণপিটুনি বন্ধে তাৎক্ষণিক কিন্তু সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিতে হবে।

তবে নাগরিক হিসেবে নিজেদের দায়িত্বও এড়াতে পারি না। গণপিটুনিতে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মতো পাশবিক আচরণ না করে শুধু নামে নয় প্রকৃত সচেতন মানুষ হয়ে উঠুন। তা না হলে আজ না হয় কাল আপনি-আমিও গণধোলাইয়ের শিকার হতে পারি!

শরীফা উম্মে শিরিন : চেয়ারম্যান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper