ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এরশাদপঞ্জী

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৪:৫৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৫, ২০১৯

বাংলাদেশের প্রবল আলোচিত-সমালোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, স্বৈরাচারীর তকমা লাভ, ডা. মিলন, নূর হোসেনসহ কয়েকজনকে হত্যার দায়, প্রেমময় বিতর্কিত ব্যক্তিগত জীবন ও সিংহাসন থেকে কারাবাস, ফের মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অলিন্দে হাঁটাচলা সবই রয়েছে তার জীবনে। বর্ণালী দীর্ঘজীবন শেষে গত রোববার (১৪ জুলাই) পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। তার জীবনের অভিযাত্রার টুকরো বয়ান...

(১৯৩০-৫০)

অবিভক্ত ভারতের কুচবিহার জেলায় ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মায়ের সঙ্গে তার শৈশব এবং স্কুলজীবন কেটেছে ভারতের কুচবিহারের দিনহাটায়। সেখান থেকেই পাস করেছেন এসএসসি। পরে দেশভাগের পর তার পরিবার চলে আসে রংপুর। সেখানে এসে কারমাইল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ালেখা করেন। চার ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে এরশাদ মেজো। সবার বড় বোনের নাম ছিল পেয়ারী আর এরশাদের নাম ছিল পেয়ারা। বাবা মকবুল হোসেন পেশায় আইনজীবী আর মা মজিরা খাতুন গৃহিণী ছিলেন। এরশাদ রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন ক্লাবে ভাড়ায় ফুটবল খেলতেন, এছাড়া তিনি তখন থেকেই কবিতা লিখতেন এবং কারমাইকেল কলেজের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। সে সময় জেনারেল এরশাদ সেনাপ্রধান ছিলেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর সে সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং তার নেতৃত্বে বিএনপিরই সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। সে সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ে ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা ছিলেন, বেশ আগে অবসর নেওয়া সেই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিচারপতি আবদুস সাত্তার সরকারের দু’মাস পরই জেনারেল এরশাদ কয়েকজন জেনারেলকে নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে মন্ত্রীদের ব্যাপারে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন এবং এভাবে দেশ চলতে পারে না বলে বার্তাও দিয়েছিলেন।’

সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, বিচারপতি সাত্তারকে বার্তা দেওয়ার পর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন।

ক্ষমতা দখলের পর দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে তিনি বাংলাদেশে দ্বিতীয় বারের মতো সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ওই সময় তিনি নতুন এক স্লোগান চালু করেছিলেন, সেটি ছিল ‘নতুন বাংলাদেশ, গড়ব মোরা...।’ তিনি তার সেই স্লোগান দিয়ে গানও লিখেছিলেন।

প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন ১৯৮৩-র ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে তার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে ছাত্ররা। এরপর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে রাষ্ট্রপতি হন এরশাদ। ১৯৮২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে মজিদ খানের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিল। সে বছরই নভেম্বরে তৈরি হয়েছিল সব ছাত্র সংগঠনের অংশ গ্রহণে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’।

পরের বছর ১৯৮৩ সালের ১৪ এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নামে। এ সময় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহাসহ অন্তত পাঁচজন। ১৯৮৪ সালে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করে সেলিম ও দেলোয়ারকে। তার শাসনের সময় আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আরও অনেকে নিহত হয়েছে। তিনি ১৯৮৬ সালে আওয়ামী, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের রাজনীতিকদের নিয়ে গড়েন ‘জাতীয় পার্টি’ (জাপা)। শুরুতে বিভিন্ন দল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ আজিজ এবং মওদুদ আহমদসহ অনেক রাজনীতিককে নিয়ে জাতীয় পার্টি নামের দল গঠন করেন। ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচন করে রাষ্ট্রপতি হন এরশাদ।

এরই মাঝে রাজনৈতিক দলগুলো তার বিরুদ্ধে যৌথভাবে আন্দোলন শুরু করেছিল। তাকে স্বৈরাচার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। এছাড়া ১৯৮৮ সালে তিনি মূল ধারার দলগুলোর বয়কটের মুখে একতরফা নির্বাচন করলেও তিনি বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি। ওই বছরই সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে তিনি ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করেন। তখন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-প্রধান দুই দলই এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু পরে কোনো দলই আর এর পরিবর্তন করেনি।

এরশাদ সরকারের তৎকালীন সহকর্মীরা পরবর্তীতে জানান, ‘রাজনৈতিক সংকট সামাল দেওয়ার জন্য একটি কৌশল হিসেবে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।’

নব্বইয়ের গণআন্দোলনে নতুন মাত্রা দিয়েছিল পটুয়া কামরুল হাসানের ‘দেশ আজ বিশ^বেহায়ার খপ্পরে’ শিরোনামের স্কেচ দিয়ে। এছাড়া দেশের কবি, শিল্পী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এরশাদের বিরোধীতায় নামে।

এ সময় পিঠে ‘ স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে মিছিল করার সময়ে নিহত হন নূর হোসেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও ১৯৮৮ সালে সব দল একযোগে বর্জন করে সংসদ নির্বাচন।

তারপর আন্দোলন আরও ব্যাপকতা পায় ১৯৯০ সালে। বিএমএ নেতা ডা. শামসুল আলম মিলন ও ছাত্রনেতা নাজির উদ্দিন জেহাদ নিহত হওয়ার পর তুমুল আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। তিন জোটের আস্থাভাজন ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন।

এরপর রাষ্ট্রপতির পদে বসেন শাহাবুদ্দিন আহমদ; তার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের পুনঃযাত্রা শুরু হয়। ক্ষমতায় থাকাকালে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নেন এরশাদ। তিনি ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছিলেন এবং দেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। হাইকোর্ট বা উচ্চ আদালতকে রাজধানী ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, বিরোধিতার মুখে সেই উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। তার সময়ই প্রথম উপজেলা এবং জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছিল। তার ক্ষমতার শেষদিকে উপজেলা নির্বাচনও হয়েছিল। এছাড়া স্বাধীনতা-পরবর্তী দশকজুড়ে সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খলা ও উপদলীয় সংঘাত ছিল, সেটি এরশাদ প্রশমিত করেছেন। জিয়ার আমলে ১৭/১৮টি সেনা অভ্যুত্থান হলেও এরশাদের আমলে একটি অভ্যুত্থানও হয়নি। তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করতে না পারলেও যে সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন, তার সদস্যদের আস্থা অর্জন করেছিলেন।


(১৯৫০-৮০)
উকিল হতে চাওয়া এরশাদ আইন পড়া শেষ হওয়ার আগেই ১৯৫২ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান। চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট, পশ্চিম পাকিস্তানের ৫৪তম ব্রিগেডের মেজর, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়ক এবং সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) সেক্টর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন এরশাদ। এ নিয়ে রয়েছে তুমুল বিতর্ক। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি বাংলাদেশে এসে আবার পাকিস্তানে ফিরে যান। তবে এরশাদের ভাষ্য, তিনি বন্দি হিসেবে সেখানে ছিলেন। পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে দেশে ফেরেন। তার মামা বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়ার সুপারিশে এরশাদ সেনাবাহিনীতে ফের যোগ দেন। এ সময় অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হন তিনি; তখন তার পদমর্যাদা ছিল কর্নেল।

১৯৭৫ সালে এরশাদ ভারতে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশগ্রহণকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হন। জিয়ার উদ্যোগে ভারত থেকে এনে এরশাদকে মেজর জেনারেল পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান করা হয়। ১৯৭৮ সালে হন সেনাপ্রধান। পরের বছর পদোন্নতি পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে।


(১৯৮০-৯০)
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। সে সময় জেনারেল এরশাদ সেনাপ্রধান ছিলেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর সে সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং তার নেতৃত্বে বিএনপিরই সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। সে সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ে ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা ছিলেন, বেশ আগে অবসর নেওয়া সেই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিচারপতি আবদুস সাত্তার সরকারের দু’মাস পরই জেনারেল এরশাদ কয়েকজন জেনারেলকে নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে মন্ত্রীদের ব্যাপারে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন এবং এভাবে দেশ চলতে পারে না বলে বার্তাও দিয়েছিলেন।’

সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, বিচারপতি সাত্তারকে বার্তা দেওয়ার পর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন।

ক্ষমতা দখলের পর দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে তিনি বাংলাদেশে দ্বিতীয় বারের মতো সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ওই সময় তিনি নতুন এক স্লোগান চালু করেছিলেন, সেটি ছিল ‘নতুন বাংলাদেশ, গড়ব মোরা...।’ তিনি তার সেই স্লোগান দিয়ে গানও লিখেছিলেন।

প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন ১৯৮৩-র ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে তার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে ছাত্ররা। এরপর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে রাষ্ট্রপতি হন এরশাদ। ১৯৮২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে মজিদ খানের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিল। সে বছরই নভেম্বরে তৈরি হয়েছিল সব ছাত্র সংগঠনের অংশ গ্রহণে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’।

পরের বছর ১৯৮৩ সালের ১৪ এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নামে। এ সময় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহাসহ অন্তত পাঁচজন। ১৯৮৪ সালে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করে সেলিম ও দেলোয়ারকে। তার শাসনের সময় আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আরও অনেকে নিহত হয়েছে। তিনি ১৯৮৬ সালে আওয়ামী, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের রাজনীতিকদের নিয়ে গড়েন ‘জাতীয় পার্টি’ (জাপা)। শুরুতে বিভিন্ন দল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ আজিজ এবং মওদুদ আহমদসহ অনেক রাজনীতিককে নিয়ে জাতীয় পার্টি নামের দল গঠন করেন। ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচন করে রাষ্ট্রপতি হন এরশাদ।

এরই মাঝে রাজনৈতিক দলগুলো তার বিরুদ্ধে যৌথভাবে আন্দোলন শুরু করেছিল। তাকে স্বৈরাচার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। এছাড়া ১৯৮৮ সালে তিনি মূল ধারার দলগুলোর বয়কটের মুখে একতরফা নির্বাচন করলেও তিনি বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি। ওই বছরই সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে তিনি ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করেন। তখন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-প্রধান দুই দলই এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু পরে কোনো দলই আর এর পরিবর্তন করেনি।

এরশাদ সরকারের তৎকালীন সহকর্মীরা পরবর্তীতে জানান, ‘রাজনৈতিক সংকট সামাল দেওয়ার জন্য একটি কৌশল হিসেবে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।’

নব্বইয়ের গণআন্দোলনে নতুন মাত্রা দিয়েছিল পটুয়া কামরুল হাসানের ‘দেশ আজ বিশ^বেহায়ার খপ্পরে’ শিরোনামের স্কেচ দিয়ে। এছাড়া দেশের কবি, শিল্পী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এরশাদের বিরোধীতায় নামে।

এ সময় পিঠে ‘ স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে মিছিল করার সময়ে নিহত হন নূর হোসেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও ১৯৮৮ সালে সব দল একযোগে বর্জন করে সংসদ নির্বাচন।

তারপর আন্দোলন আরও ব্যাপকতা পায় ১৯৯০ সালে। বিএমএ নেতা ডা. শামসুল আলম মিলন ও ছাত্রনেতা নাজির উদ্দিন জেহাদ নিহত হওয়ার পর তুমুল আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। তিন জোটের আস্থাভাজন ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন।

এরপর রাষ্ট্রপতির পদে বসেন শাহাবুদ্দিন আহমদ; তার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের পুনঃযাত্রা শুরু হয়। ক্ষমতায় থাকাকালে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নেন এরশাদ। তিনি ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছিলেন এবং দেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। হাইকোর্ট বা উচ্চ আদালতকে রাজধানী ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, বিরোধিতার মুখে সেই উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। তার সময়ই প্রথম উপজেলা এবং জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছিল। তার ক্ষমতার শেষদিকে উপজেলা নির্বাচনও হয়েছিল। এছাড়া স্বাধীনতা-পরবর্তী দশকজুড়ে সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খলা ও উপদলীয় সংঘাত ছিল, সেটি এরশাদ প্রশমিত করেছেন। জিয়ার আমলে ১৭/১৮টি সেনা অভ্যুত্থান হলেও এরশাদের আমলে একটি অভ্যুত্থানও হয়নি। তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করতে না পারলেও যে সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন, তার সদস্যদের আস্থা অর্জন করেছিলেন।


(১৯৯০-২০১৯)
১৯৯১ সালে কারাগারে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে হত্যা এবং দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ৪২ টি মামলা সচল হয়। এরমধ্যে অন্যতম মামলা ছিল মেজর জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলা, রাডার দুর্নীতি মামলা, জনতা টাওয়ার মামলা ইত্যাদি। এরমধ্যে মঞ্জুর হত্যার ঘটনায় কেটে গেছে দীর্ঘ ৩৮ বছর। এ মামলার প্রধান আসামি এরশাদ। এ মামলায় রায়ের জন্য বহুবার দিন ধার্য হলেও রায়ের আগে আবার অধিকতর তদন্তের জন্য সময় চাওয়া হয়। এরপর পরিবর্তন হয়ে যায় বিচারক। এভাবে ১৯৮১ সালে হত্যার পর মামলা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৫ সালে।

মামলা কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর গত ২৪ বছরে নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ২২ জন বিচারক বদলি হয়েছেন। মঞ্জু হত্যার দীর্ঘ ৩৮ বছরেও রায় হয়নি এ হত্যা মামলার; বরং এ মামলাকে ব্যবহার করে এইচ এম এরশাদ হয়ে যান রাজনীতিতে ‘তুরুপের তাস’। অন্যান্য মামলা থেকে মুক্তি পেলেও মঞ্জুর হত্যা মামলার আসামি হয়েই তিনি মারা গেলেন। এসব মামলা তিনি এরশাদ একাধিক বার বলেছেন, গত ২৯ টি বছরের একটি দিনও আমি শান্তিতে কাটাতে পারিনি।’ এ মামলার খাঁড়া ঝুলিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দশকের পর দশক এরশাদকে কাছে টেনেছে, তার সমর্থন আদায় করেছে। ৯১ এর নির্বাচনে জেলে থেকে নির্বাচন করে একাই পাঁচ আসনে জয়ী হন। জাপা পায় ৩৫টি আসন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জেলে বসেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেন তিনি। ওই নির্বাচনে সরকার গড়ে আওয়ামী লীগ। ছয় বছর জেল খাটার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি জেনারেল এরশাদ জামিনে মুক্তি পান।

দলের নেতৃত্বভার নেন স্ত্রী রওশন এরশাদের কাছ থেকে। এরপর বিভিন্ন সময় নানা ভাগ হয় এরশাদের দল। মূল দল নিয়ে ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেন তিনি। এরপর টানাপড়েন ও নানা অনুযোগ করলেও আওয়ামী লীগের কাছাকাছিই থেকেছিলেন এরশাদ।

এরপরও সারা দেশে বিশেষকরে রংপুরে এরশাদের তুমুল জনপ্রিয়তা বজায় রয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময় তিনি নানা সিদ্ধান্ত বদলের ঘটনায় তীব্র সমালোচিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের সময় জেনারেল এরশাদ তার বক্তব্য বা অবস্থান বার বার বদল করেছিলেন। ফলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পছিল। গত দশম সংসদে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ছিলেন।

সর্বশেষ ২০১৮সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এরশাদের নেতৃত্বে ২২টি আসন পায় জাপা। ৮৯ বছর বয়সে জেনারেল এরশাদ এই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন । জেনারেল এরশাদ তার অনুপস্থিতিতে ছোট ভাই জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। আর রওশনকে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব দেন। রওশন ছাড়াও এরশাদের আরেক স্ত্রী রয়েছেন। নানা গুঞ্জনের প্রেক্ষাপটে ২০০০ সালে জেনারেল এরশাদ একজন ফ্যাশন ডিজাইনার বিদিশা ইসলামকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর এই নারী বিদিশা এরশাদ নামে পরিচিত হন। তবে সেই ঘর বেশি দিন টেকেনি। দুই স্ত্রীর ঘরে তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে। তারা হলেন- রাহগির আল মাহি এরশাদ, এরিক, আরমান এরশাদ ও জেবিন।

বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়ে দেশের অন্যতম আলোচিত সমালোচিত ব্যক্তিত্ব এরশাদ গতকাল রোববার মৃত্যুবরণ করেন।

 
Electronic Paper