ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কম্পিউটার শিশুদের কী দরকার?

শেখ আনোয়ার
🕐 ১০:১০ অপরাহ্ণ, জুলাই ০৮, ২০১৯

আপনার সোনামণি শিশুর হাতে কম্পিউটার তুলে দিয়েছেন তো? না দিয়ে থাকলে এখনই দেবেন কি দেবেন না এ নিয়ে নিশ্চয়ই আপনি দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও উদ্বিগ্ন? কারণ এসেছে নতুন সময়। ডিজিটাল যুগ। আপনার শিশুটিও ডিজিটাল প্রতিযোগিতায় নামবে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এই প্রতিযোগিতায় তাকে টিকতে হবে।

নিশ্চয় আপনিও এসব ভাবছেন? শিশুদের কম্পিউটার শিক্ষা নিয়ে আপনার মতো অনেকেই এরকম উদ্বিগ্ন। দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছেন, ‘স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা আর থাকবে না। শিক্ষাবিষয়ক সব সমস্যার সমাধান দেবে কম্পিউটার। আমাদের শিশুদের মেধা বিকশিত করবে এই কম্পিউটার।’ এ সুযোগে কম্পিউটার ব্যবসায়ীরা একটি মোক্ষম যুক্তি দাঁড় করিয়েছে। শিশুদের হাতে কম্পিউটার তুলে দিতে তাদের প্রচারণা আরও জোরদার করেছে। স্লোগান দিচ্ছে ‘শুরুতেই লাভ’। তাই আর দেরী নয়। এখনই শুরু করুন। আপনার সোনামণির হাতে কম্পিউটার তুলে দিন। যত তাড়াতাড়ি শুরু করবেন তত তাড়াতাড়ি সুফল পাবেন। কম্পিউটার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘বাজারে যেসব প্রোগ্রাম বেরিয়েছে সেগুলো শিশুদের ভবিষ্যৎ উন্নতি লাভে দারুণ সম্ভাবনাপূর্ণ।’ সত্যিই কি তাই? সম্ভবত না। কারণ?

সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রে আপনার শিশু যা শিখতে পারে সফটওয়্যার কি সেসব শিক্ষা দিতে পারে? সফটওয়্যার সত্যিকার অর্থেই কি কোনো শিক্ষা সংক্রান্ত সাহায্য করতে পারে? না। তা পারে না। সফটওয়্যার ওটা পারবেও না। সমালোচকদের দৃঢ় জবাব। ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পুরো শিষ্টাচার, আচরণ, বাস্তবতা এসব শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা সফটওয়্যারের নেই। আর তাই, শিশুদের হাতে কম্পিউটার দেওয়া মানেই তাদের ভুল পথে তাড়িত করা। ‘কম্পিউটার আসলে শিক্ষামূলক মানবিক অগ্রগতি চাপা দিয়ে রাখে’-এই হলো বিজ্ঞানী জেইম হেইলির গবেষণার সারাংশ। জেইম হেইলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিষয়ক মনঃস্তাত্ত্বিকদের অন্যতম। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার গবেষণা গ্রন্থ ‘ফেইলিউর টু কানেক্ট’।

এই গ্রন্থে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, কম্পিউটার শিক্ষামূলক সফটওয়্যার থেকে উদ্ভূত সমস্যা খতিয়ে দেখতে হবে। ব্যাপারটি আরও কাছ থেকে দেখতে হবে। কারণ শিশুদের হাতে কম্পিউটার তুলে দিলে কতটা লাভ হবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গেলেও কি চলবে? বিষয়গুলো এখন আরও একান্তভাবে নিরীক্ষণের সময় এসেছে।

হেইলির এই যুক্তি-মন্তব্যের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, তিনি শিশুদের হাতে কম্পিউটার তুলে দেওয়ার ঘোরবিরোধী মোটেও নন। বরং বাচ্চাদের প্রযুক্তিগত প্রেরণা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তিনি। থিসিস প্রকাশের আগে হেইলি টানা তিন বছর স্কুলে স্কুলে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাই শিশুদের হাতে কম্পিউটার দেওয়া প্রসঙ্গে তার মানসিকতার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন এ ব্যাপারে একটি সাদামাঠা মন্তব্য ছুড়েছেন, ‘সাত বছরের কম বয়সী শিশুর হাতে কম্পিউটার দেওয়ার কোনো মানে নেই। সত্যি সত্যিই কোনো দরকার নেই।’

তবে এ কথা ঠিক, অনেক বাবা মা-ই ভাবেন দোলনার শিশুটিকে এ মুহূর্তেই যদি কম্পিউটারের সামনে বসানো যেত, হামাগুঁড়ি দেওয়া সোনামণির হাতে যদি মাউস ধরিয়ে দেওয়া যেত। তাহলে আগেভাগেই জাদু মানিক শিশুটি কম্পিউটার শিখে ফেলত। কদিন বাদে তো শিখতেই হচ্ছে। এসব বাবা-মার উদ্দেশে হেইলির ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য-‘ধ্যাৎ! এসব বাবা-মা কিবোর্ডে প্রচুর পরিমাণে শিশুদের লালা ঝরাতে দিচ্ছেন। হেইলি ব্যাখ্যা করে বোঝান, সাত বছর বয়সের পর কম্পিউটার নিয়ে শিশুদের গেম খেলায় কোনো সমস্যা নেই।

সাতের ঊর্ধ্ব বয়সী শিশুরা কম্পিউটারের মাধমে দ্রুততার সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিটি পোক্ত করতে পারে। এ ছাড়া আর কোনো লাভ নেই। শিশুর বাস্তব জীবনের কোনো বিকাশ ঘটে না। তবু সাত বছর ঊর্ধ্ব বয়সী শিশুদের কম্পিউটার থেকে দূরে রাখা যাবে না। হেইলি উল্লেখ করেন, শিশুরা এক নাগাড়ে খুব বেশিক্ষণ গেম খেলায় মেতে থাকতে পারে। যেমন-প্রতিযোগিতায় উদ্বুদ্ধকারী গেম, অ্যাকশনধর্মী কার্টুন, নাচ-গান ইত্যাদি। কারণ হিসেবে হেইলি যুক্তি দেখান, গেম আর বিনোদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিশুদের ৫০ শতাংশই ঝরে পড়ে। এক সময় কম্পিউটারের আসল শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের আগ্রহ কমে যায়। কম্পিউটারের প্রতি বিরক্তি জন্মে। সৃষ্টিশীল মেধা বিকশিত হতে পারে না।

বিজ্ঞানী হেইলি এজন্য বাবা-মাকেই দোষী সাব্যস্ত করেছেন। আজ-কালকার বাবা-মা, সাধারণ একটি পিসির ওপর খুব বেশি বিশ্বাস রাখেন। তারা কম্পিউটারকে ম্যাজিক বা অলৌকিক শক্তি মনে করেন। অলৌকিক শক্তিতে শক্তিশালী করার কথা ভেবেই বাবা-মা’রা শিশুদের জন্য কম্পিউটার কিনেন। সফটওয়্যার কিনেন। বিশেষ করে মার্কিনিরা যেন দেখতে চায়, যন্ত্র সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। মার্কিনিরা এটি বিশ্বাস করেই ফেলেছে। তবে শিশুরা সফটওয়্যারের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। যুগের সেরা আধুনিক মানব হচ্ছে তা কিন্তু নয়। বাবা মা’র উচিত, এ ব্যাপারে চোখ-কান খোলা রাখা। জেনে রাখা দরকার, যারা সফটওয়্যার তৈরি করেছেন, তারা কিন্তু শিশুদের মেধা বিকাশের ব্যাপারে সবজান্তা নন। হেইলি জানান, আমি কম্পিউটার কোম্পানি থেকে কনসালটেন্সি কাজের অফার পেয়েছিলাম। প্রত্যাখ্যান করেছি এসব ভেবেই।

উল্লেখ্য, বাজারের শিক্ষামূলক সফটওয়্যার নির্মাতা কোম্পানিগুলো বিক্রি বাড়াতে এখন একদম পিচ্চি বাচাদের টার্গেট করেছে। গত বছর প্রকাশিত ‘ল্যাপ ওয়্যার’ প্রোগ্রামকে সমালোচকরা ‘ড্রোল ওয়্যার’ বলে ব্যঙ্গ করতেন। কারণ এসব সফটওয়্যার বিক্রির জন্য টার্গেট করা হয় মাত্র নয় মাস বয়সী শিশুদের। আর কে না জানে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত ‘নলেজ অ্যাডভান্সমেন্ট জাম্প স্টার্ট বেবি’ নামক সফটওয়্যার প্রোগ্রামটি বিক্রি হয় পঞ্চাশ হাজার কপি। সম্প্রতি ওই একই সফটওয়্যার জাম্প এহেড বেবি নাম দিয়ে ব্রিটেনের বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিক্রিটা মন্দ হবে না।

এই সফটওয়্যারের প্রোডিউসার হচ্ছেন ভিরনা হারভি। তিনি বলেন, ‘এটি এমন এক প্রোগ্রাম কেবল নির্দিষ্ট পয়েন্টে ক্লিক করলেই শিশুতোষ ধাঁধার বইয়ের রুপান্তর ভেসে ওঠে পর্দায়। যাতে রয়েছে শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিচিতি। কাপড়-চোপড়, পোশাক-আশাকের নাম। আর রয়েছে সাধারণ গেম। এর অর্থ বই-পুস্তকের আসন দখল করেছে সফটওয়্যার, তা কিন্তু নয়। আমাদের এই প্রকাশনার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাবা-মা অবসরে শিশুদের নিয়ে কম্পিউটারে বসবেন। এই প্রোগ্রাম বাবা মা-ই ব্যবহার করবেন। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়। শিশুদের কি সত্যি সত্যিই এমন প্রোগ্রাম দরকার?

হেইলি বলেন, না। অন্তত আমি তা মনে করি না। বরং মনে করি, শিশুরা এর দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আহত হচ্ছে। সফটওয়্যার ব্যবসায়ী ভিরনা হারভি বলেছেন অন্যকথা। যেসব বাবা-মা এসব কিনতে চান, আমরা চাই তারা কিনুন। লাইন ধরেই কিনুন। শিশুদের শিক্ষামূলক সফটওয়্যারের একজন বিক্রেতা হিসেবে আমি খুবই উচ্ছ্বসিত। আমাদের সফটওয়্যার কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, এ কথা স্পষ্ট করে বলতে পারি। তা ছাড়া অপ্রাসঙ্গিক কোনো অভিযোগ আমরা এখনো পাইনি। আপনি না কিনলে না-ই কিনবেন। না কিনলে আপনার বাচ্চা স্কুলে গিয়ে ভালো করবে না, এমন পরামর্শ তো আমরা দেই না। আমরা কখনই বলি না যে, আমাদের সফটওয়্যার শিশুদের উৎপাদনমুখী জীবনের নেতৃত্ব দেবে। যদি বলতাম, তবে সেটিই হতো অপ্রাসঙ্গিক।

সফটওয়্যার ‘জাম্প এহেড’কে ব্রিটেনের অভিভাবক সংস্থা ‘পিন’ (প্যারেন্টস ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক) কট্টর সমালোচনা করেছে। পিন শিশুদের কম্পিউটার ব্যবহার প্রসঙ্গে গাইড বই প্রকাশ করেছে। সে গাইডে বলা হয়েছে, জাম্প এহেড শিশুদের দুঃসাহসিক জ্ঞান বাড়ায় ঠিক। তবে তাতে ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। এজন্য সেটি এড়িয়ে চলা উচিত। তবে পরিত্যাগ করতে পারলে সবচেয়ে ভালো। পিন অবশ্য শিক্ষামূলক সফটওয়্যার আর শিশুদের ওপর প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে এখনো সন্দিহান। তবে তাদের মতামত হচ্ছে, পুরোপুরি কম্পিউটার শিক্ষিত একটি পরিবারে যদি হাঁটতে না জানা কোনো শিশু থাকে, এই সফটওয়্যার সেই শিশুটির জন্য কতটা মূল্যবান হতে পারে?

অন্যক্ষেত্রে বিশেষ করে কম্পিউটার অশিক্ষিত পরিবারে এরূপ কম্পিউটার সফটওয়্যার আসলেই বিরক্তিকর এক বাজে জিনিস। এ প্রসঙ্গে হেইলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাম্প স্টার্ট এর বিরূপ সমালোচনা করেছেন। তার মন্তব্য, একটি নির্দিষ্ট বয়সে শিশুর প্রকৃতিগত শিক্ষা দরকার। তা থেকে শিশুদের ফিরিয়ে রাখা কিংবা অন্যদিকে তাড়িত করা একটি অমানবিক কাজ। শুধু তথ্যপ্রযুক্তিগত মেধা বিকাশের জন্য শিশুটিকে ঠেলা-ধাক্কা দেওয়া মোটেই উচিত নয়।

শিশুকে জোর করে যন্ত্রের মধ্যে ঢোকানো বড়দের উচিত নয়। কারণ আজ যে শিশু কম্পিউটার ব্যবহার করছে, এক সময় সেই শিশু হাঁফিয়ে উঠবে। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে যাবে। এই শিশু যদি পরিণত বয়সে পৌঁছার পর কম্পিউটার ব্যবহার অব্যাহত রাখে তবে তো ভালো কথা। অন্যথায় পিসি শুধু মাল্টিমিডিয়া আর টিভি বিনোদনের মতোই সীমাবদ্ধ হবে। তবুও কম্পিউটার। মন্দ নয়। অন্তত তুলনামূলক টিভির চেয়ে লেটেস্ট। কেবল বিপথে তাড়িত হলেই অবশ হয়ে যায় শিশুদের মেধা ও মনন।

শেখ আনোয়ার : বিজ্ঞান লেখক; গবেষক সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 
Electronic Paper