ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দেশটা দুর্ভাগা নয় মানুষগুলো দুর্ভাগা

ড. এম এ মাননান
🕐 ১০:১১ অপরাহ্ণ, জুলাই ০৪, ২০১৯

ছোটকালের শেখা আপ্তবাক্যগুলো এখন আর মনে রাখতে কিংবা শুনতে একবারেই ভালো লাগে না। মুরুব্বিরা বলতেন, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আরও বলতেন, শিক্ষকরাও জাতির মেরুদণ্ড। কোন শিক্ষাটা জাতির মেরুদণ্ড, তা নিয়ে যথেষ্ট ফাঁপরে পড়ে যাই আজকাল। যে শিক্ষা কিছু জংলি ছাত্র নামধারীরা দিবে সেটা, নাকি যে শিক্ষাটা সুশিক্ষিত ব্যক্তিরা (যাদের আজকাল দয়া করে ‘শিক্ষক’ বলা হয়) দিবে সেটা? জংলি ছাত্রদের জংলিপনা যেভাবে বাড়ছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, তাতে মনে হয় না ‘শিক্ষক’ নামের কারও কোনো প্রয়োজন আছে।

‘ছাত্র’ কথাটা বলছি এ জন্য যে, ছাত্রীরা এখনো জংলিপনাটা মনে হয় রপ্ত করতে পারেনি। আশীর্বাদ করি, তারা যেন যেভাবে আছে সেভাবেই চিরকাল থাকে। তাহলে অন্তত এটুকু সান্ত্বনা থাকবে যে, জাতির ভবিষ্যৎদের একটা অংশ হলেও এখনো সুশিক্ষা নিতে চায়, দেশটাকে যাতে কেউ ‘দুর্ভাগা’ না বলতে পারে সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারবে। কেন জানি মনে হয়, আমাদের মেয়েরা-কন্যারাই আমাদের ভবিষ্যতের দিকপাল। এরাই বাঁচিয়ে রাখবে শিক্ষকদের সম্মান।

এটা কেন মনে হলো? ২ জুলাই চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ৬৮ বছর বয়সী, এক সময়ের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা সুনামধারী শিক্ষককে যেভাবে কতিপয় ছাত্র নামধারী জংলি দুর্বৃত্ত টেনেহেঁচড়ে ভবনের বাইরে নিয়ে গিয়ে লাঞ্ছিত করে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল (শেষ পর্যন্ত পারেনি শুধু কয়েকজন ছাত্রীর কাকুতি-মিনতির কারণে), সেখানে দুর্বৃত্তায়নের গণ্ডির বাইরে থাকা ছাত্রীরাই শেষ পর্যন্ত একজন নিরীহ অধ্যাপকের সম্মানসহ জান বাঁচিয়ে ছিল। তাদের মতো কন্যাদের ধন্যবাদ জানাই।

ছাত্রীরাই এখন দেখছি দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায়, প্রতিষ্ঠানে রুখে দাঁড়াচ্ছে। জোর আওয়াজ তুলছে। প্রতিবাদী হচ্ছে। এমনকি জীবন বাজি রেখে প্রকাশ্য রাস্তায় হামলাকারী-খুনিদের রুখে দিচ্ছে, প্রতিহত করছে। বীর পুরুষরা তো হাতে চুড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হয়। যেমনটা দেখেছি বরগুনায় খোলামেলা রাস্তায় নয়ন বন্ডের মতো অল্প বয়সী দুর্বৃত্তরা একজন যুবককে তার স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেললো অথচ উপস্থিত কয়েকশ ‘পুরুষ-যুবক-ছাত্র’ টুঁ-শব্দটি করল না। সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত প্রতিবাদী হয়ে লম্পট অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে কিন্তু জীবিত থাকা অবস্থায় ধমকি-হুমকিতে পিছপা হয়নি।

মাদ্রাসাছাত্ররা কিন্তু নুসরাতের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। অনেক স্কুল-কলেজে ছাত্রীরাই প্রতিবাদী হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছে, লড়ছে। একটা বিরাট অংশের ছাত্রের মধ্যে নিস্পৃহতা দেখে আমরা শঙ্কিত। চট্টগ্রামের ঘটনায় বহু ছাত্র সেখানে ছিল, তারা তো দর্শকের ভূমিকা নয় শুধু, রীতিমতো হামলাকারীদের সহায়কের ভূমিকা নিয়েছে। সত্যিই আমরা হতভাগা। আমাদের দেশ ঠিক আছে, ঠিক নেই শুধু আমরা। এই আমরা কারা? আমরা তরুণ-তরুণীরা। ছেলেরা চারদিকে নির্যাতকের ভূমিকায় নেমেছে। নির্যাতিত হচ্ছে মেয়েরা। তারপরও মেয়েরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে রাস্তায় নামছে। মনে হয়, ভবিষ্যৎ মেয়েদের হাতেই। চট্টগ্রামের ইউএসটিসির সেই ছাত্রীদের বলছি, তোমরা বুঝিয়ে দিয়েছ, যেসব দুর্বৃত্ত ছাত্র তোমাদের সামনে তোমাদের প্রিয় শিক্ষককে শুধু নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশে তাদেরই শিক্ষককে অপমান করেছে, মেরে ফেলতে চেয়েছে, তারা পুরো শিক্ষক জাতিকে অপমান করেছে। আর তোমরা কয়েকজন ছাত্রী শিক্ষকের সম্মান রক্ষা করেছ, দুর্বৃত্তদের আগুন থেকে বাঁচিয়েছ। এও তোমরা বুঝিয়ে দিয়েছ, তারা একজন শিক্ষককে অপমান করে সারা দেশের শিক্ষকের গায়ে অপমানের ধুলা ছিটিয়েছে এবং সে কারণে ‘অপমান হতে হবে তাহাদের সবার সমান’। আমরা চাই না, এমন দুর্বৃত্ত সন্তান কারও ঘরে জন্মগ্রহণ করুক, এমন অসভ্য-বর্বর ছাত্র কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকুক। যারা এসব কুসন্তানের জনক-জননী তাদেরও ধিক্কার জানাই; তারা তাদের সন্তানদের জন্ম দিয়েই দায়িত্ব সেরেছেন, মানুষ করার দায়িত্ব নেননি। শিক্ষককে পুড়িয়ে মারার মতো ঘৃণ্য উল্লাসে মেতে ওঠা কলঙ্কের মশালধারী ওই ছাত্ররা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্নিত দুর্বৃত্ত। তাদের স্থানীয় নেতারাও চেনেন। ওখানকার সবাই চেনেন। এমনতরো চেনাজানা কলঙ্কিত ছাত্র নামধারীদের সবারই বিচার দ্রুত করতে হবে, এ দাবি করা নিশ্চয়ই অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

কিছু পত্রিকার খবর থেকে মনে হয় (যদি সত্য হয়), এ বর্বর অচিন্ত্যনীয় ঘটনা সংঘটনে প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের ইন্ধন থাকতে পারে। এরূপ প্রমাণিত হলে তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি। শাস্তি না হলে কিংবা শাস্তি দেওয়ার কাজটি বিলম্বিত হলে দুর্বৃত্তরা আরও বেপরোয়া হয়ে যাবে, যা হবে সমাজের জন্য অশনি-সংকেত। আর এ কথাও ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, এরাই সরকারের সব অর্জনকে তাদের দুর্বৃত্তায়িত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একেবারেই ম্লান করে দেয়, জনমনে সরকার এবং সরকারি দলের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি করে। আমাদের আশা-ভরসার স্থল যিনি সেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যাকেও অনুরোধ করব, তিনি যেন সোনাগাজী আর বরগুনার মতোই চট্টগ্রামের এ দুর্বৃত্ত, ছাত্র নামের কলঙ্কগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে শিক্ষক সমাজের সম্মান ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন।

ড. এম এ মাননান : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত
বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট

 
Electronic Paper