ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সরিষার ভেজাল তেলে সম্পদের পাহাড়

আবু বকর সিদ্দীক
🕐 ১০:২২ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০১, ২০১৯

ভেজাল সরিষার তেল বিক্রি করে দিনমজুর থেকে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার আফজাল হোসেন ওরফে হাজি আকমল হোসেন। তার সরবরাহকৃত ভেজাল তেলের কারণে প্রাণ কোম্পানিকেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। কোম্পানির এক কর্মকর্তার যোগসাজশে এ ভেজাল তেল প্রাণের বোতলে সারা দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উল্লাপাড়া সদর ইউনিয়নের মাগুরাডাঙ্গা গ্রামের শাহজাহান আলীর ছেলে আকমলের সম্পদের উত্থান আলাদিনের চেরাগকেও হার মানায়।

জানা গেছে, চুরির দায়ে দুদফা গণপিটুনি খান আফজাল হোসেন। পরে তিনি দিনমজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ১৯৮৮ সালে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। এর পরেই চোরের তকমা কাটাতে নাম বদলে আফজাল হোসেন হয়ে যান আকমল হোসেন। ২০০৬ সালে নিজেই মিল স্থাপন করেন। এর পরে আকমল সরিষার ভেজাল তেল উৎপাদন করে তা সরবরাহ শুরু করেন প্রাণ কোম্পানিতে। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে শতবিঘা কৃষি জমি, পৌরসভায় ১০ বিঘা জমি, জেলা শহরের শ্যামলীপাড়ায় মার্কেটসহ আলিশান ৫তলা বাড়ি, ১০টি ট্রাক ও একাধিক মাইক্রোবাস এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে প্রায় তিনশ’ কোটি মূল্যের সম্পদ রয়েছে তার।

আরও জানা গেছে, বর্তমানে তার প্রায় শতকোটি টাকার ভেজাল তেল মজুদ রয়েছে। উপজেলার আলম কসাইয়ের পাট বন্দরে প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের ১৫০ গাড়ি তেল, পাট বন্দরে নিজের গোডাউনে ১২ কোটি মূল্যের ১০০ গাড়ি, বাকুয়ায় তার বড় জামাই জহুরুলের মিলের পেছনে ৪ কোটি টাকা মূল্যের ৩০ গাড়ি, চোকিদহে নিজস্ব মিলে রাখা আছে ২০ কোটি মূল্যের ২০০ গাড়ি তেল। এছাড়া কয়ড়া ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামে বিশাল গোডাউন ও চাতাল করে সেখানে প্রায় ৫০০ গাড়ি সরিষা মজুদ করে রেখেছেন আকমল, যার বাজার মূল্য ৫০ কোটি টাকা।

উল্লাপাড়ায় হাজি আকমলের আব্দুল্লাহ অয়েল মিলে বিষাক্ত কেমিক্যাল, পোড়া মবিল, পামওয়েল, পিঁয়াজের ঝাঁজ, শুকনো মরিচের গুঁড়া, মাস্টার্ড ও ইস্ট কেমিক্যালসহ রঙ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে ভেজাল সরিষার তেল। চীন থেকে বিভিন্ন নামে আমদানি করেন বিশেষ ধরনের সরিষা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গোপনে উৎপাদিত এসব ভেজাল তেল ড্রামভর্তি করে ট্রাকযোগে চলে যায় প্রাণ কোম্পানির নাটোর কারখানায়। বিশেষ ব্যবস্থায় প্রতিদিন এসব ভেজাল তেল ড্রামে ট্রাকযোগে সেখানে নেওয়া হয়। সেখান থেকে প্রাণ কোম্পানির মোড়কে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

নাটোরের একডালায় অবস্থিত প্রাণ কোম্পানির জিএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বিশেষ চুক্তির মাধ্যমেই এ কারবার দীর্ঘদিন চলে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিদিন ১২, ১৮ থেকে ২৪ লাখ টাকা মূল্যের তেল দিতেন আকমল। সেখানে ড্রামভর্তি এক গাড়ি তেলের দাম পড়তো ১২ লাখ। নিম্নমানের এ তেল লেনদেনের মাঝে চুক্তি মোতাবেক মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন জিএম নাসির। তিনিও বর্তমানে বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেছেন। দীর্ঘদিন এ ব্যবসা চলে এলেও মাস ছয়েক আগে তা সাময়িক বন্ধ রয়েছে।

সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে জিএম নাসিরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, হাজি আকমল হোসেন নামে কারও সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। তার কাছ থেকে তেল নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। প্রাণ নিজস্বভাবে তেল উৎপাদন করে যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকে।

অভিযুক্ত আকমল হোসেন বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, প্রাণ কোম্পানির জিএম নাসির স্যারের মাধ্যমে ওই কোম্পানিতে আগে তেল সরবরাহ করতাম। ৭ থেকে ৮ মাস আগে প্রতি মাসে এক ট্রাক, দুই ট্রাক করে ব্যারেল হিসাবে তেল সরবরাহ করতাম। ওরা নিয়ে কোন মোড়কে বিক্রি করত তা আমার জানা নেই।

খাদ্যপণ্যে ভেজালের বিষয়ে নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুষ্টিবিদ তাসনিম আশিক বলেন, সরিষার তেলে কোনো আয়রন বা লৌহ জাতীয় পদার্থ থাকার কথা নয়। তবে সরিষার তেলে পাওয়া গেছে আয়রন। অন্য ধরনের তেলের মধ্যে এক ধরনের কেমিকেল মিশিয়ে ‘ঝাঁজ’ সৃষ্টি করে তা সরিষার তেল বলে বিক্রি করা হয়।

এর আগে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে একটি কারখানা সিলগালাসহ ৫ হাজার লিটার ভেজাল সরিষার তেল মাটিতে ঢেলে ধ্বংস, ২ ব্যবসায়ীকে ২ লাখ টাকা জরিমানা, সম্প্রতি একজনকে ৭০ হাজার এবং অন্যজনকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে ম্যানেজ করে সেখানে আকমলসহ বেশ কিছু কারবারি ভেজাল তেলের উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় প্রাণের সরিষার তেলের মধ্যেও ভেজাল পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

 
Electronic Paper