ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আমরা কি শুধু নীরব দর্শক

শামীম সিকদার
🕐 ১০:১২ অপরাহ্ণ, জুন ২৯, ২০১৯

বরগুনায় প্রকাশ্য দিবালোকে জনবহুল সড়কে স্ত্রীর সামনে স্বামী শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে (২৬) চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। স্ত্রীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে একই শহরের ধানসিঁড়ি সড়কের আবুবকর সিদ্দিকের ছেলে নয়ন বন্ড এবং তার প্রতিবেশী দুলাল ফরাজীর দুই পুত্র রিফাত ফরাজী ও রিসন ফরাজী। এ ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার কারণে আমরা সবাই জানি। স্বামীকে বাঁচাতে প্রাণপণ লড়াই করেন স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারলেন না প্রাণপ্রিয় জীবনসঙ্গীকে।

কেবল তারা জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছিলেন। তবে ঘাতকরা তা আর স্থায়ী হতে দিল না। ঘটনাস্থলে বহু লোক দাঁড়িয়ে হত্যার দৃশ্য দেখছিল কিন্তু কেউ রিফাতকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। মিন্নি স্বামীকে বাঁচাতে বার বার আহ্বান জানালেও উৎসুক জনতা সাড়া দেয়নি। মিন্নি সাংবাদিকদের কাছে ঘটনা বর্ণনা দেন এভাবে-‘আমি আর আমার হ্যাজবেন্ড কলেজ থেকে বের হই। হঠাৎ আমাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। অনেক চেষ্টা করছি, স্বামীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। ওখানে অনেক লোক ছিল তারা যদি এগিয়ে আসত তাহলে হয়তো আমার স্বামীর এমন করুণ মৃত্যু হতো না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই, অপরাধীর ফাঁসি চাই।’

কখনো স্বামীকে আড়াল করার চেষ্টা, আবার চাপাতি হাতে উদ্যত দুই জল্লাদকে ঝাপটে ধরার চেষ্টা, কিন্তু স্বামীকে বাঁচানোর সব চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। চাপাতির ক্রমাগত আঘাতে ততক্ষণে রিফাতের সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে নিস্তেজ প্রায়। খুব অল্প সময়ে হত্যাযজ্ঞ শেষ করে অস্ত্র উঁচিয়ে বীরদর্পে এলাকা ত্যাগ করে খুনিরা। গুরুতর অবস্থায় রিফাতকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রথমে বরগুনা সদর হাসপাতালে এবং পরে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় রিফাত।

নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিওর নির্মম দৃশ্যগুলো মানুষকে হতবাক করে দিয়েছে। এমন দৃশ্য মেনে নেওয়া কষ্টের। ক্ষোভে ফেটে পড়েন দেশের বিবেকবান মানুষ। এর পরপরই ফেসবুকে বইতে থাকে নিন্দার ঝড়। ক্ষোভ, ঘৃণা, প্রতিবাদ ও খুনিদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

এক সময় মানুষ অন্যের বিপদে কোনো চিন্তা না করেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বরগুনার ঘটনায়ও একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে হয়তো রিফাতের জীবন রক্ষা পেত। প্রশ্ন উঠেছে, মানুষ কি এখন আর অন্যের বিপদে এগিয়ে যাবে না? আমরা কি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি? দুই/তিনজন সন্ত্রাসী সবার সামনে একজন মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করে বীরদর্পে চাপাতি উঁচিয়ে চলে গেল কেউ কোনো প্রতিবাদ করল না!

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, সৎ কাজের আদেশ কর এবং মন্দ কাজের প্রতিরোধ কর। আমরা কি পারছি মন্দ কাজের প্রতিরোধ করতে? চোখের সামনে প্রতিদিন কত অন্যায় কাজ হচ্ছে। সাহস করে তো আমরা প্রতিরোধ করতে পারছি না। হয়তো আমরা হয়রানির ঝামেলায় কেউ কারও বিপদে এগিয়ে যাই না। এই ভয়ে যদি সবাই হাত গুটিয়ে বসে থাকি তাহলে অপরাধীরা তো আরও উৎসাহী হবে। ধরে নিলাম রিফাতকে হত্যার সময় অহেতুক ঝামেলায় জড়ানোর আশঙ্কায় কেউ এগিয়ে যায়নি, তাহলে দূরে বসেও তো রিফাতকে বাঁচানোর চেষ্টা করা যেত। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে যে কেউ জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশকে ঘটনাটি জানাতে পারত। তাহলে পুলিশ ঘটনাস্থলে আরও আগে এলে হয়তো রিফাত বেঁচে যেত।

বৃহস্পতিবার ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনলে মহামান্য হাইকোর্টেও বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের দ্বৈত বেঞ্চ এক আদেশ দেন। এ আদেশ দেওয়ার সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রকাশ্য রাস্তায় এভাবে কুপিয়ে হত্যা করল অথচ স্ত্রী ছাড়া তাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে এলো না। সবাই দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখল।’ আদালত আরও বলেন, ‘এটা জনগণেরও ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মানুষ তো এমন ছিল না। রিফাত শরীফকে তার স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় আমরাও মর্মাহত।’

লেখক বুদ্বিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এ ঘটনা সমাজের যে সামগ্রিক অবক্ষয়, তারই পরিচয়। আগে এমনটা ছিল না। তখন একজন মানুষকে বাঁচানোর জন্য অন্যরা এগিয়ে যেত। প্রখ্যাত সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, এই জঘন্য বর্বরোচিত আক্রমণ যখন নিরপরাধ নিরস্ত্র রিফাতের ওপর চলছিল, তখন পাশেই অনেক পুরুষ দাঁড়িয়েছিল। তারা নপুংসক কিনা জানি না। তবে নির্বোধ আবেগ অনুভূতিহীন সমাজের চরম স্বার্থপর বাসিন্দা তারা। মোবাইলে ছবি তুলে, ভিডিও করে, যেন এক আদিম মধ্যযুগীয় হত্যাকা-কে উপভোগ করছে, নয়তো ভাবছে যার খুশি মরুক, আমার কী? একদিন এই জাতি নিরস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে প্রতিরোধ যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছিল। একদিন এই সমাজ সহজ-সরল মানবিক ছিল। সামাজিক নৈতিক দায়িত্ববোধ ছিল সবার মাঝে। সাহস ছিল, আবেগ-অনুভূতি ছিল, মায়া-মমতা ছিল। এখন সব হারিয়ে নিজের ষোলআনা স্বার্থে অন্ধ বিবেকহীন হয়ে পড়েছে। এখন আমরা আর মানুষ নই, একেকজন স্বার্থান্ধ হিসেবি নপুংসক দাঁড়িয়ে আছি। রিফাত হত্যার ছবি যত দেখি, বুকটা তত খাকখাক করে আগুনে পুড়ে, ছটফট করি, ঘুম আসে না। আমরা একদম নিজ স্বার্থে ডুবতে ডুবতে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছি।

রিফাতের ঘটনায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থার এক কঠিন এবং রূঢ় চিত্র যেন উঠে এলো। কারও বিপদে এমন নির্মোহ, নিষ্ক্রিয়তা ও নির্লিপ্ততা মানবিকতার পরিপন্থী। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, মানুষের প্রতি মানুষের এহেন নির্লিপ্ততা কেন বাড়ছে? মানুষের এহেন আচরণের কারণ কী? এটা কি শুধুই নিজেকে ঝামেলা থেকে রক্ষা করার জন্য, নাকি মানুষের মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়? এ কেমন মানসিকতা? তবে কি দিন দিন আমরা বোধহীন হয়ে যাচ্ছি? আমাদের মনুষ্যত্ব লোপ পাচ্ছে? কোনো ধর্মই এমন মনোভাব সমর্থন করে না।

মানবতার ধর্ম ইসলাম অন্যের বিপদে এগিয়ে যাওয়াকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এটাকে সওয়াবের কাজ বলে ঘোষণা করেছে। এই বোধটুকু সজাগ থাকলে অনেক অপরাধ কমে যাবে। সেক্ষেত্রে নৈতিক কারণে যারা বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করতে এগিয়ে যান, তারা যেন কোনো ধরনের উটকো ঝামেলা না পোহান, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। আরেকটি কথা, নিজেরা পরবর্তী সময়ে ভোগান্তিতে পড়তে চান না বলেই বেশির ভাগ মানুষ এসব বিষয় এড়িয়ে চলেন। কথা হলো, এ ধরনের ঘটনায় কাউকে বাঁচাতে বা উপকার করতে গেলে ঝামেলা পোহাতে হবে কেন? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা জরুরি। না হলে এমন নির্লিপ্ততার ধারালো ছুরির ফলা যে একদিন আমাকে-আপনাকে ছোবল দেবে না; সে নিশ্চয়তা কে দেবে?

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অত্যাচার, অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। তিনি ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারি! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’ সাধ্যমতো মানবসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা ধর্ম ও মানবিকতার দৃষ্টিতে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ। সাহায্য করা অনেকভাবেই হতে পারে। কথা দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে, শ্রম দিয়ে, সঙ্গে থেকেও সাহায্য করা যায়। সংকটে ও বিপদে মানুষ মানুষকে সাহায্য করতে হবে। না হলে মানবজন্ম অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মানব জীবনের সম্পূর্ণতা আর তৃপ্তির প্রয়োজনে মানুষের জন্য কিছু করা দরকার। আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আক্ষেপ করতে হয়, ‘হে মানুষ তুমি আবার মানুষ হও’।

আসুন, মানুষের উপকারে নিজেকে আত্মনিবেদন করি। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে যদি একটি প্রাণ বাঁচে, একজন মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখে, তাতে হয়তো আমাদের জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া হবে মহাআনন্দের এবং সুখের। জয় হোক নিপীড়িত মানুষের, জয় হোক মানবতার।

শামীম সিকদার : শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]

 
Electronic Paper