ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন

ত্রাতার ভূমিকায় শেখ মুজিব

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৫৯ অপরাহ্ণ, জুন ২৬, ২০১৯

দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আ.লীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে খোলা কাগজের বিশেষ প্রতিবেদন আজ দ্বিতীয় পর্ব

 

সোহরাওয়ার্দীর বৈদেশিক নীতি নিয়ে বিরোধের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলে দলের মধ্যে সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। সুযোগসন্ধানী নেতারা ভেবেছিলেন এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান দল থেকে পদত্যাগ করলে সাধারণ সম্পাদকের পদটি করায়ত্ত করা যাবে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে মন্ত্রিত্বের চেয়ে দলের স্বার্থই সব সময় অগ্রগণ্য ছিল। তাই ওই বছরের ৩১ মে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে ১৩-১৪ জুন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ডাকেন তিনি।

এই কাউন্সিলের মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগে ঐতিহাসিক বাঁক বদল ঘটে। সম্মেলনে উপস্থিত কাউন্সিলররা বিপুল ভোটে সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতি অনুমোদন করেন। এতে প্রচণ্ড নাখোশ হন ভাসানী। ওই কাউন্সিলে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের সে সম্মেলনেই ভাসানীর শেষ উপস্থিতি ছিল।

এরপর ওই বছরের ২৫ জুলাই ভাসানীর উদ্যোগে আয়োজিত নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করা হয়, যার সভাপতির দায়িত্ব নেন মওলানা ভাসানী। একই বছরের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন সোহরাওয়ার্দী। আওয়ামী লীগের ভাঙন ও সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পর ক্ষমতার পালাবদল চলে দ্রুতলয়ে। ক্ষমতার পালাবদলে অস্থির হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি। আওয়ামী লীগের মধ্যেও তার প্রভাব পড়ে।

১৯৫৪ থেকে ৫৮ সালের মধ্যে পূর্ববঙ্গে সাতটি জোট সরকার গঠন ও বাতিল করে কেন্দ্রীয় সরকার। মূলত সুপরিকল্পিতভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল পূর্ব বাংলায় স্থিতিশীল সরকার গঠন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

১৯৫৮-এর ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জারি করে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন। এর পর পূর্ব বাংলার জনগণ ও রাজনৈতিক নেতাদের ওপর চলে অভাবিত দমনপীড়ন। ওই অবস্থায় নাজুক হয়ে পড়ে দলগুলোর সাংগঠনিক অবস্থা। বিশেষ করে ভাঙনের মুখে পড়া আওয়ামী লীগ আইয়ুব আমলের শুরু থেকেই সীমাহীন সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। অবরুদ্ধ রাজনৈতিক পরিবেশ ফেরাতে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলো ফের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে। আইয়ুবের চ-নীতির কারণে অবরুদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলো কৌশলে অরাজনৈতিক আবরণ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করছিল শুরু থেকেই। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ তুলে শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড়। সেই সময় অনেক নেতাই শেখ মুজিবুর রহমানকে আত্মগোপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আত্মগোপনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না বলে কোথায় পালিয়ে যাননি। ১২ অক্টোবর রাতে গ্রেফতারবরণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৫৯ সালের ১৮ জুলাই শেখ মুজিব ছাড়া পেলেও ১৯৬১ সালের ২১ জুন শেখ মুজিব হাইকোর্টের রায়ে মামলা থেকে মুক্ত হন। ওই বছর ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল আইয়ুব প্রেসিডেন্টের গদি দখল করেন। রাজনীতিবিদদের নামে মিথ্যা দুর্নীতি মামলা দিয়ে আইয়ুব সরকার তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করলে অনেক নেতাই রাজনীতি ছেড়ে দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন, মৌলভী তমিজুদ্দিন খান প্রমুখ।

১৯৬২ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানে নতুন সংবিধান চালু হয়। সেই সঙ্গে চালু হয় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা। ওই বছরের ৮ জুন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সামরিক আইন তুলে নেওয়া হয়। সামরিক শাসন তুলে নেওয়ার পর নিজেদের দলকে পুনরুজ্জীবিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেন রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষনেতারা। এর মধ্যে আইয়ুবের নানা ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে ছত্রছন্ন হয়ে যায় বিভিন্ন দল। মুসলিম লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন আইয়ুব খান নিজেই। দমনপীড়নে বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেন শেখ মুজিব। এর মধ্যে শরীফ শিক্ষা কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তান।

ছাত্রলীগ ও ছাত্রইউনিয়ন যৌথভাবে শরীফ কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামে। ১৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব বাংলায় হরতাল ডাক দেয় তারা। ওইদিন ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা যান বাবুল ও মোস্তফা। পরদিন মারা যান ওয়াজিউল্লাহ নামের আরেক ছাত্র। ঐতিহাসিক সে আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতিতে আইয়ুব সরকার বাধ্য হয় শরীফ কমিশনের রিপোর্ট স্থগিত করতে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন ছাত্রনেতারা বৃহত্তর রাজনৈতিক জোয়ার তৈরির একটা সুযোগ পেয়ে যান।

অবশ্য ’৬২ সালের মাঝামাঝি সময়েই শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ়বিশ্বাস জন্মে যে, দেশে আর সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আইয়ুব খান বছরের পর বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবেন। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিরাজমান তিক্ততাপূর্ণ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্র ফেরানোর বিকল্প সম্ভাবনা দেখছিলেন। তিনি ভারতের সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সূচনার চেষ্টা করেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে লেখা চিঠিতে মুজিব এমন অভিপ্রায়ই ব্যক্ত করেন। মুজিবকে সহযোগিতা দিতে নেহেরু সম্মত হলেও চীনের সঙ্গে যুদ্ধে বিপর্যস্ত ভারত একটু সময় চেয়েছিল মুজিবের কাছ থেকে।

এর মধ্যে ১৯৬৩ সালের ২ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সঙ্গে দেখা করেন মওলানা ভাসানী। এর পর থেকে পাকিস্তানের বিরোধী দলের রাজনীতির মোড় ঘুরে যেতে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসে ভাসানী চীন সফরে যান। বছরের শেষ দিকে চীন থেকে ফিরে আইয়ুব সরকারকে সমর্থন দেন ভাসানী।

১৯৬৪ সালের ৯ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ডাকেন শেখ মুজিব। মতবিরোধের প্রেক্ষাপটে সে সভায় অনুপস্থিত থাকেন আতাউর রহমান ও আবুল মনসুর। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই বছরের মার্চের ৬ ও ৭ তারিখ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ সভাপতি নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকেন। এনডিএফের খোলস ছেড়ে আওয়ামী লীগের নবযাত্রা শুরু হয়।

১৯৬৫ সালে আইয়ুবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষে ১৯৬৪ সালের ২১ জুলাই সম্মিলিত বিরোধী দল (কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি-কপ) নামের একটি নির্বাচনী জোট গঠন করা হয়। এ জোট পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতেমা জিন্নাহকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী মনোনীত করে। আইয়ুবের ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের কারণে কপে দেখা দেয় বিভক্তি। কপের নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে পরাজয়বরণ করতে হয় ফাতেমা জিন্নাহকে।

১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাপ তৈরি হলে দলের অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী ন্যাপে চলে যান। এর পর সামরিক শাসনামলের শুরু থেকে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর। শেখ মুজিব নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। সামরিক শাসন উঠে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতা রাজনীতিতে আর সক্রিয় থাকেননি। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের ভার একা শেখ মুজিবকেই বয়ে বেড়াতে হয়। দলে বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ নেতার আকাল পড়ে। ওই সময় শেখ মুজিবের প্রধান অবলম্বন ছিল ছাত্রলীগের তরুণ নেতাকর্মীরা।

১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সুনির্দিষ্ট প্রথম ছয় দফা উত্থাপন করেন। উপস্থিত সবার আপত্তির মুখে শেখ মুজিবের প্রস্তাব সম্মেলনের এজেন্ডার না রাখা হলে তিনি সম্মেলন ওয়াকআউট করেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে ছয় দফা তুলে ধরেন।

ছয় দফা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের মধ্যেও বিভক্তি দেখা দেয়। শেখ মুজিবেরও সন্দেহ ছিল কার্যনির্বাহী কমিটি তাকে সমর্থন না-ও দিতে পারে। এমনকি দলের সভাপতি আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের মতো নেতাও ছয় দফার বিরোধিতা করেন। তবে আওয়ামী লীগের তৃণমূল ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সব সময় তার পাশে ছিলেন। তিনি জানতেন তারাই শেষ পর্যন্ত তাকে সমর্থন জানাবেন। ছয় দফা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য শেখ মুজিব ১৮-১৯ মার্চ ঢাকার হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল আহ্বান করেন। মতবিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে দলের সভাপতি আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের অনুপস্থিতিতে সভায় সভাপতিত্ব করেন সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কাউন্সিল ছয় দফাকে অনুমোদন করেন। ওই কাউন্সিলেই দলের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রথমবারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ।

ছয় দফা পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নতুন প্রাণ পায়। আওয়ামী লীগ ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি’। ছয় দফা প্রকাশের পর সরকার আওয়ামী লীগ ও তার নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। এর ফলে ছয় দফার পক্ষে সারা দেশে আরও বেশি জনমত গড়ে উঠে।

শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি মামলা দিয়ে হয়রানি করতে থাকে। ৮ মে গ্রেফতার করা হয় তাকে। এর পর ৭ জুন শেখ মুজিবের মুক্তি ও ছয় দফা দাবির পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ। ৭ জুনের হরতালের আগে আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষনেতাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। এতে আরও উত্তাল হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তান। ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে অপরিহার্য ও অবিসংবাদিত হয়ে উঠেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং একক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ হয়ে উঠে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

 
Electronic Paper