ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শেষ ধাপেও নৌকার প্রতিপক্ষ আ.লীগ

মনোজ দে
🕐 ১০:৫২ অপরাহ্ণ, জুন ১৯, ২০১৯

উপজেলা নির্বাচনের শেষ ধাপেও আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থীদের বড় একটা অংশ হেরেছেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে। জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন বলে বিবেচনা করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র দুই মাসের মাথায় শুরু হওয়া এ নির্বাচন ঘিরে ছিল তাই বাড়তি আগ্রহ।

বিএনপি এতে অংশ না নেওয়ায় অনেকটাই উত্তাপ হারালেও আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল এই নির্বাচন। কেননা সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও ছিল প্রার্থীর দীর্ঘ সারি। এদের মধ্যে কাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তা নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগকে। মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীদের চাপ এতটাই বেশি ছিল যে, একপর্যায়ে ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ ও নারী) পদে নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। শুধু চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়।

দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বারবার নৌকার মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে দলের সবার প্রতি কাজ করার জন্য নির্দেশ দেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হলে কিংবা মন্ত্রী-এমপি কেউ দলের প্রার্থীর বিপক্ষে গেলে তাদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যাওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি আসে শীর্ষ নেতৃত্বের তরফ থেকে। কিন্তু কোনো নির্দেশনা কিংবা হুঁশিয়ারি কাজে আসেনি। পাঁচ ধাপে উপজেলা নির্বাচনে প্রায় ৯০ জনের মতো স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এদের সিংহ ভাগই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। বিভিন্ন উপজেলায় দলের মন্ত্রী, এমপিরাই বিরোধিতা করেছেন নৌকার প্রার্থীকে। ফলে তাদের কাছেই হারতে হয়েছে নৌকাকে।

সর্বশেষ গত পরশু শেষ ধাপে ২০ উপজেলায় ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ের পাল্লায় ভারী। তিনটি উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হলেও বাকি ১৭টিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। নয়টি উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছেন। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলায় সিপিবি সমর্থিত প্রার্থী আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছেন। বাকি আটটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।

যেসব উপজেলায় নৌকার মনোনীত প্রার্থী হেরেছেন এর মধ্যে মাদারীপুরের সদর উপজেলা নিয়ে সবার আগ্রহের কেন্দ্র ছিল। কেননা এ আসনে নৌকার প্রার্থী কাজল কৃষ্ণ দে ছিলেন আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিমের আশীর্বাদপুষ্ট। নৌকা মার্কার এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন ওবাইদুর রহমান কালু খান। তিনি সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের স্নেহধন্য। উত্তেজনাপূর্ণ এ নির্বাচনে প্রায় আট হাজার ভোটের ব্যবধানে নৌকার প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। এ উপজেলার নির্বাচনকে ঘিরে উত্তেজনার পারদ এতটা ছড়িয়ে পড়ে যে, ভোট পরবর্তী সহিংসতায় নৌকার পক্ষে কাজ করা একজন যুবলীগ নেতা নিহত হয়েছেন।

৪৯২ উপজেলার মধ্যে ৫ ধাপে ৪৮৫ উপজেলায় এবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এরমধ্যে ৫ ভাগের একভাগ উপজেলাতেই বিদ্রোহী আর স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছেন। এসব উপজেলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে মনোনীত নৌকার প্রার্থী মন্ত্রী কিংবা স্থানীয় এমপিদের বিরোধিতার মুখে পড়েন। কোথাও কোথাও নিজেদের লোকদের তারা আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেন। কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ গোপনে তাদের নিজ নিজ প্রার্থীর পক্ষে প্রচার কাজে অংশ নেন। দলের হাইকমান্ড থেকে বারবার সতর্ক করার পরও তাদের নিবৃত্ত করা যায়নি।

দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে নেতাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা মোটেই সন্তুষ্ট নয়। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করছেন, এটা অনেক বড় শৃঙ্খলাপরিপন্থী কাজ। নৌকার প্রার্থী মানে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থী। এমপি-মন্ত্রীরাই যখন দলের মনোনীত প্রার্থীর বিপরীতে কাজ করেন সেটা দলের জন্য একটা খারাপ নজির হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীদের যারা ইন্ধন দিয়েছেন দলের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ তাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বর্ধিত সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অক্টোবরে যে জাতীয় সম্মেলন হতে যাচ্ছে তার আগে যে কমিটি করা হবে সেখানে নেতাদের পছন্দের লোকের চেয়ে দলের প্রতি নিবেদিতদের তুলে আনার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কমিটি করতে গিয়ে নিজের লোক খুঁজবেন না, দলের লোক খুঁজবেন। কেউ নিজের থাকবে না। সবাই আওয়ামী লীগের, সবাই শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকবে। নিজের লোক কখনো চিরস্থায়ী থাকে না। দলের জন্য কাজ করুন। দুঃসময়ের দলের নেতাকর্মীদের অবহেলা করবেন না। যারা অসহায় অসচ্ছল তাদের পাশে দাঁড়ান।’

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের যে হিড়িক তাতে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডও চিন্তিত। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় স্থানীয় সরকারের প্রেস্টিজিয়াস এ নির্বাচনে বেশির ভাগ জয় পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি তাদের। কিন্তু বিদ্রোহীরা ভুগিয়েছে চরমভাবে। এ ক্ষেত্রে অসন্তোষও দেখা দিয়েছে তৃণমূলে। এ প্রেক্ষাপটে গত মে মাসে গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ড ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের যৌথ সভায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তির নির্দেশ দেন।

জানা গেছে, দলের যেসব মন্ত্রী ও এমপি নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করেছেন তৃণমূলের অভিযোগের ভিত্তিতে এর সত্যতা যাচাই-বাছাই করছেন সংশ্লিষ্টরা। যাদের বিরুদ্ধে দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তাদের কাছে এ ধরণের কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা চেয়ে কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। উত্তর পেলেই তা পর্যালোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় কাউন্সিলের আগে উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলে দলের সাংগঠনিক পরিস্থিতি একটা আদ্যোপান্ত ধারণা পাওয়া গেছে। টানা তিন দফা ক্ষমতায় থাকায় দলের ভেতরে নেতৃত্বের জট তৈরি হয়েছে। কোথাও কোথাও তা বিরোধে রূপও নিয়েছে। অক্টোবরে যে কাউন্সিল হবে সেখানে দলের তৃণমূল নেতৃত্ব নতুন করে সাজানো হবে। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে দেশের সবচেয়ে বড় দল। আগামীতে দলকে আরও বিস্তৃত করা হবে।

উন্নয়নের ধারাবাহিকতার যে ম্যান্ডেট নিয়ে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ তা বাস্তবায়নে সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধ সংগঠন ছাড়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে যাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার যোগ্যতা থাকবে তারাই নেতা হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকবেন। উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহে যারা ইন্ধন দিয়েছে সাময়িক লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদি তাদের জন্য ভালো সংবাদ নেই।

 
Electronic Paper