ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সাফল্যের গল্প

চোখের আলো নেভাতে পারেনি জ্ঞানের আলো

নাজমুল মৃধা
🕐 ৩:০৫ অপরাহ্ণ, জুন ০২, ২০১৯

অনেকের ধারণা প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝাস্বরূপ। কিন্তু এটাও দেখতে হবে, ইতিহাসে এমন অনেক প্রতিবন্ধী মানুষ আছেন যারা পৃথিবীকে দিয়ে গেছেন মহামূল্যবান সম্পদ। যাদের ধ্যান-জ্ঞান আর মানবতায় হার মেনেছে অনেক স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ। স্টিফেন হকিং, ফ্রিডা কাহলো, ক্রিস্টি ব্রাউন, হেলেন কেলার প্রমুখ তেমনি কয়েকজন। তাদের মতো না হলেও তাদেরই অনুসরণ করে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার এক কিশোরী।

মুনিরা ইয়াসমিন ঋতু একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ড থেকে পেয়েছেন গোল্ডেন জিপিএ-৫। রাজশাহীর ভদ্রা এলাকায় তাদের বাসা। তার নিজ জেলা নওগাঁ। বাবা নওগাঁর একটি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মা মেরিনা পারভীন রিনা একজন গৃহিণী। তার এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প।

জন্ম থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মুনিরার পথ চলা মোটেও সহজ ছিল না। তার চোখের জ্যোতি একেবারেই কম। চিকিৎসার জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে দৌড়ালেও ডাক্তাররা দেয় কষ্টের সংবাদ। মুনিরার চোখের কোনো চিকিৎসা নেই। চোখে চশমা পরিধান করে থাকলেও তা কোনোই কাজে আসে না। বাকিটা জীবন এভাবেই চলতে হবে। যতটুকু দেখতে পান তা সূর্যের আলো আর পড়ার জন্য প্রখর আলোসম্পন্ন টেবিল ল্যাম্পের মাধ্যমে। দিনের বেলাতেও চার দেয়ালের ভেতরে এলে লাগে টেবিল ল্যাম্প। বিভিন্ন পরীক্ষার সময় কেন্দ্রে যেখানে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক আলোতে লিখতে পারেন সেখানে মুনিরা শুধু মানুষের ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না।

কেন্দ্রের ভেতরে যাতে মেয়ে পরীক্ষা দিতে পারে সে জন্য মা মেরিনা পারভীন সবসময় টেবিল ল্যাম্প সঙ্গে নিয়ে নিয়ে ঘোরেন। সূর্যের আলোতে মুনিরা দেখলেও তা কেবলই সামান্য। হাঁটার সময় সে খুব সাবধানে পা ফেলে। পরিচিত জায়গায় চলতে সুবিধা হলেও অপরিচিত জায়গায় একেবারেই হাঁটতে পারেন না।

২০০৯ সালে মুনিরার একাডেমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাজশাহীর ‘পিনাকল স্টাডি হোম’র মাধ্যমে। পরে ‘শাহিন স্কুল’ লক্ষ্মীপুর শাখায় ভর্তি হন দ্বিতীয় শ্রেণিতে।

সেখানে তৃতীয় শ্রেণিতে তিনি তার মেধার মাধ্যমে বৃত্তি পান। তারপর রাজশাহীর ভদ্রা এলাকার সাইদুর রহমান একাডেমিতে ভর্তি হন চতুর্থ শ্রেণিতে। সেখানে চতুর্থ শ্রেণিতে বৃত্তি এবং পঞ্চম শেণিতে পান বোর্ড বৃত্তি। এরপর ভদ্রা এলাকায় অবস্থিত অক্ষর একাডেমিতে ভর্তি হন ষষ্ঠ শ্রেণিতে।

সেখানে সফলতার সঙ্গে পড়াশোনা করে ২০১৬ সালের জেএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ড থেকে পান জিপিএ-৫। সর্বশেষ ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় পান গোল্ডেন জিপিএ-৫।কিন্তু সে প্রথম দিকে যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তে যান অনেকেই বলেছে মুনিরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, তার দ্বারা পড়াশোনা হবে না। তার ক্লাসের বন্ধুরা যখন দেখত সে টেবিল ল্যাম্পের মাধ্যমে লিখছে, পড়ছে বন্ধুরা খুব হাসাহাসি করত।

মুনিরার মা বলেন, ‘মুনিরার স্কুলের শিক্ষকরাও বলেছে এ পারবে না একে দিয়ে কি করবেন। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। মুনিরার অদম্য ইচ্ছাশক্তি আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছে।’

মুনিরার আজকের এই সফলতার গল্পটা শুরু মায়ের হাত ধরেই। এখনো পর্যন্ত সংসারের সব ঝামেলা সামলেই চলে আসেন মুনিরাকে নিয়ে। মুনিরার ছায়াসঙ্গী তার মা। দুই মেয়ে আর এক ছেলের মধ্যে মুনিরা মেজো। মুনিরার মা মুনিরাকে বোঝা মনে করেন না। বরং একজন আদর্শ মায়ের মতোই মেয়ের নানা সমস্যার সমাধান করে যাচ্ছেন। আগামী দিনগুলোতেও এই অদম্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ের পাশে থেকে মেয়ের স্বপ্নগুলোকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে চান।

মুনিরা শুধু পড়াশোনাতেই না তার রয়েছে আশ্চর্য সব প্রতিভা। সে ড্রয়িং করতে পারে যেকোনো কিছু। কবিতা, ছোটগল্প লিখাতেও সে পটু। সে নানারকম হস্তশিল্প নির্মাণ করতে পারে। দৃষ্টিহীনতা তাকে পিছিয়ে দিচ্ছে না বরং দৃষ্টিহীনতাকে সামনে রেখে জীবনের নানা জটিলতাকে জয় করার ইচ্ছার কথা জানান মুনিরা।

বড় হয়ে সে দৃষ্টিহীনদের জন্য কিছু করতে চায়। মুনিরা বলেন, ‘আমাকে নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করেছে। আমি জানি এটা কত কষ্টের। আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যারা প্রতিবন্ধী তাদের জন্য একাডেমি প্রতিষ্ঠিত করে ব্যবহারিক জ্ঞান দিতে চাই।’

 
Electronic Paper