ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

স্মৃতি ও সঞ্চয়

সেলিনা হোসেন
🕐 ৪:৪০ অপরাহ্ণ, মে ৩১, ২০১৯

শৈশব-কৈশোরের সময়ের ঈদ ছিল শুধুই উৎসব। অনাবিল আনন্দে দিন উদযাপন। নতুন জামা কখন কেনা হবে, মাংস-পোলাও কখন রান্না হবে এসবই ছিল ছোটবেলার ঈদ। তখন সমাজ-বাস্তবতা বোঝার বয়স ছিল না। ধনী-দরিদ্রের শ্রেণি বৈষম্যের তাত্ত্বিক ধারণা লাভ করার প্রশ্নই ছিল না। তবে ধর্মীয় উৎসব হলেও হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে পালন করার ধারণা তখন থেকে পেতে শুরু করি। এটাই আমার ঈদের স্মৃতির সবচেয়ে বড় অর্জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বুঝেছি এটি আমার শুধু স্মৃতির উৎসব নয়, এ উৎসবের দায়ও আছে। এখন যখন দুই ঈদের সাম্যের জায়গা চিন্তা করি তখন ঈদ আমার কাছে শুধু স্মৃতিমাত্র থাকে না। ঈদ সামাজিক দায়বোধের জায়গা থেকে চোখ খুলে পারিপার্শ্বিক দেখতে বলে। সেই দেখাই এখন ধর্মীয় উৎসবের বিচার-বিশ্লেষণ। বৈষম্য বেশি ধরা পড়ে কোরবানির ঈদে।

বাঙালি মুসলমানের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা। পরেরটি আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়। এর মহিমা অপার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা সেই শিক্ষা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। এই আয়োজন যেন দেখানোর বিষয় হয়ে উঠেছে। এমনকি অনেক সময় এটি প্রতিবেশীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার বিষয়ও বটে! অথচ ঈদুল আজহা আমাদের সেই শিক্ষা দেয় না। আমাদের সমাজে বহু মানুষ আছেন যারা গরুর মাংস কিনে খেতে পারেন না। তারা ঈদুল আজহার এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করেন। এই সংখ্যাটা কম নয়। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, কোরবানির দিনও অনেক গরিব, দুস্থ, অসহায় মানুষ রাজধানীতে থেকে যান। তারা মাংসের জন্য অপেক্ষা করেন। সেই মাংস নিয়ে তারা বাড়ি ফেরেন পরদিন অথবা তার পরদিন। তারা অপেক্ষা করেন সামাজিকভাবে যে মানুষ ধনী তাদেরই বাড়ির দরজায়।

তাদের চোখে তারা মর্যাদাবান। এই মর্যাদাবান মানুষ কিন্তু সেই মর্যাদার কথা অনেক সময় ভুলে যান। তারা মনে করেন, যে যত বেশি দামে বড় গরু কোরবানি দিতে পারবেন সমাজে তার মর্যাদা তত উঁচু হবে। এ জন্য লাখ টাকা খরচ করে কোরবানি দিতেও তারা কার্পণ্য করেন না। তাদের কোরবানির তালিকায় ইদানীং যুক্ত হয়েছে সৌদি অথবা রাজস্থানি উট, দুম্বা। তারা কোরবানি শেষে সেই মাংস গরিব দুঃখীদের মাঝে বণ্টন না করে ডিপফ্রিজে জমা করেন। সেগুলো বছর ধরে তারা খাচ্ছেন।

লোকদেখানোর জন্য কোরবানি দিয়ে সেই মাংস ফ্রিজে রেখে ঈদুল আজহা উদযাপন করছেন এমন অনেক মানুষ আমাদের চারপাশে আছে। কোরবানি ঈদের প্রকৃত সত্যটি অনুধাবন করে সমতার জায়গা নির্মাণের কথা ভাবলে আমাদের প্রিয় নবীকে শুধু একজন নবী হিসেবে নয়, একজন প্রকৃত জ্ঞানী মানুষ হিসেবে আমি তার তুলনা খুঁজে পাই না। তিনি অদ্বিতীয়। একই সঙ্গে অতুলনীয়। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে কন্যাসন্তান হলেই তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। এই করুণ বাস্তবতার বিপরীতে আমাদের নবী কঠিন অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন। নবী বলেছেন, তোমার প্রতিবেশীর থালায় ভাত আছে কি না, তার খোঁজ নাও। নবী বলেছেন, দুটি পয়সা থাকলে ফুল কিনো। কী সুন্দর নান্দনিক বোধ! তিনি বলেছেন, জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাও। সেই সময়ে এত বড় একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন আমাদের নবী।

তিনি আমার শিক্ষক, তিনি সচেতন মানুষের কাছে প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ। যাকে আমি এভাবে চিন্তা করি। তার জীবন দর্শন, তার ব্যক্তিজীবন বিষয়ে হাদিসে অজস্র কথা বলা আছে। সেখানে মানুষের সমতাসহ সব বিষয়ে বলা আছে। এই লেখাটি লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে, নবীজির চলার পথে যে বুড়ি কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন সেই ঘটনার কথা। পরপর কয়েক দিন পথে কাঁটা না দেখে নবীজি চিন্তিত হলেন। তিনি উদ্বিগ্ন হলেন এই ভেবে, আজ আমার চলার পথে কাঁটা নেই কেন? তাহলে সেই বুড়িমা কি অসুস্থ হলেন? নবী বুড়িমার খোঁজ নিলেন। এবং এই ঘটনায় নবী যে মানবতার পরিচয় দিলেন তা পৃথিবীতেই বিরল। ধর্মের সত্যের এই বিষয়গুলো আমাদের ধারণ করা উচিত। আমাদের ইসলাম শান্তির ধর্ম, সত্যের ধর্ম।

এ কথাটা সবাই মানেন, কিন্তু ধর্মের তাৎপর্যময় অর্থ কেউ বুঝতে চান না। ধর্মকে সবার আগে বুঝতে হবে। এই উপমহাদেশে যখন ইসলাম প্রচার শুরু হয়, তখন মানুষ গরিব, নিম্নবর্গের ছিল। হিন্দু ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে মানুষ নিপীড়িত ছিল। যে কারণে ইসলামের সুন্দর মানবিক মর্যাদার জায়গাটা মানুষ প্রাণভরে গ্রহণ করেছিল। না হলে এই অঞ্চলে এত মানুষ কীভাবে মুসলমান হলো? এই দেশে তো মুসলিম শাসন পরে এসেছে। ইসলাম শান্তির ধর্ম, সাম্যের ধর্ম বলেই মানুষ তা গ্রহণ করেছে। আর এই শান্তি, সাম্য ত্যাগের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব।

ঈদুল আজহা আমাদের সেই ত্যাগের শিক্ষা দেয়। মানুষে মানুষে সমতার জায়গাটা হচ্ছে, ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় সত্য। ঈদের উৎসব এভাবে মানুষের মিলনের উৎসব হয়। অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করার জায়গা তৈরি হয়। আমাদের বাংলাদেশে ধর্মের সত্য নিয়ে মানুষের মর্যাদা অমলিন থাকবে। এই বিশ্বাস নিয়ে জীবনের শেষদিন আমার সমাপ্ত হবে।

 
Electronic Paper