ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আমার ঈদ ভাবনা

আসাদ চৌধুরী
🕐 ৪:৩৮ অপরাহ্ণ, মে ৩১, ২০১৯

বয়স ’৭৫ পার হয়েছে, চুল-দাড়ি সাদা হয়ে যাচ্ছে; ফলে বর্তমান কেবল চোখে পড়ে না, ভবিষ্যৎও যেন খানিকটা দেখতে পাই। তবে বয়স বেড়ে গেলে বোধহয় সবচেয়ে বেশি চোখে ভাসে অতীত। বিশেষ করে শৈশবের স্মৃতি মনে পড়তে থাকে। ফেলে আসা দিনের জন্য মন কেমন করে। ঈদ উপলক্ষে সমকালে লিখতে গিয়ে ঈদের অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে।

আমার জন্ম হয়েছিল উলানিয়ায়, বরিশাল অঞ্চলের নামকরা জমিদার পরিবারে। এখনকার ছেলেমেয়েরা হেসে কুটি কুটি হবে যে, গরমের দিনে ঈদ হলেও তখন আমরা পায়জামা, আচকান, পাগড়ি পরতাম। আমাদের পরিবারের জন্য বাঁধা মুচি ছিল। তিনি পুরনো জুতা পলিশ করে দিতেন। আর কখনো কখনো নতুন জুতা পেলে তো কথাই নেই। বাঁধা ধোপাও ছিল, এখনো নাম মনে আছে ‘ক্ষেত্রমোহন ধুপি’। তিনি ঈদের আগে সব কাপড়-চোপড় ধুতেন। বাড়িতে বাঁধা রানারও ছিল। নলগোলা পোস্ট অফিস থেকে আমাদের পরিবারের চিঠিপত্র নিয়ে আসত এবং পোস্ট করতে যেত। সেসব দিন এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। মনে হয় যেন সেই দিন।

আমাদের অঞ্চলে প্রথম রেডিও আসে আমাদের বাড়িতে। আমার চাচাত ভাই আজেম চৌধুরী ১৯৪৬ সালে সেটা নিয়ে আসেন। বলতে গেলে আজদাহা সাইজের রেডিও। এর ব্যাটারি দুই-তিনজন জোয়ান মজুরকে বহন করতে হতো। তারা বরিশালে নিয়ে যেতেন চার্জ দিতে, আবার নিয়ে আসতেন। আমার কাছে এখনো গৌরবের বিষয় মনে হয়, হিজলা ও মুলাদী থানা থেকে দারোগা সাহেবরা পুলিশ পাঠিয়ে দিতেন সাইকেলে। যাতে করে রেডিও থেকে শুনে যায় যে চাঁদ দেখা গেছে কি না। এ নিয়ে প্রথম দিকে, কেউ কেউ ফতোয়া দিয়েছিলেন; কিন্তু প্রযুক্তির প্রতি মানুষের উৎসুকের কাছে সেগুলো টেকেনি। কারণ অনেক সময় আকাশ মেঘলা থাকত, চাঁদ দেখা যেত না। তখন ওই রেডিওই ছিল ভরসা।

ঈদের দিন শুরু হতো সকালবেলায় গোসল করার মধ্য দিয়ে। এখন অবিশ্বাস্য মনে হয়, ওই সাতসকালে, নামাজে যাওয়ার আগেই আমরা ভূরিভোজ করতাম। আমার মা মোটামুটি নির্দিষ্ট কয়েকটি পদ প্রতি ঈদের দিন সকালে করতেন। তার মধ্যে রয়েছে পোলাও, কোর্মা, ঝাল মুরগি, বুট ডাল ভুনা। ওই বুটের ডাল ছিল বিশেষ ধরনের। বাটির মধ্যে ডালের ভেতর সিদ্ধ ডিম অর্ধেক করে কাটা ও উল্টে দেওয়া থাকত। হলুদ ডালের মাঝখানে প্রথমে ডিমের সাদা অংশ, তারপর কুসুম। তিন রঙা ও সুস্বাদু খাবার। দেখেই মন ভরে যেত।

ঈদের নামাজের পর রুটিন ছিল প্রত্যেকের বাড়িতে যাওয়া। আমাদের গ্রামটা ছোট, আমাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী সবাই। আমরা জানতাম যে কোনো বাড়িতে কী খেতে দেবে।
আমার শৈশবে গ্রামের বাড়ি উলানিয়াতে যেমন ঈদ করেছি, পরের দিকে আবার ঢাকাতেও ঈদ করতে হতো। কারণ আমার বাবা এমএলএ ছিলেন। আমি প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামে পড়ে ঢাকায় ভর্তি হয়েছিলাম। ঢাকার ঈদ ছিল অন্যরকম আনন্দের, অন্তত দুটি কারণে। একটি হচ্ছে, ঢাকায় এসে প্রথম বরফ বিক্রি হতে দেখি। বিক্রেতারা চেঁচিয়ে বলত-পাহাড়িয়া বরফ। তুস দিয়ে ঢাকা থাকত। আসলে হতে পারে, মুঘল আমলে ঢাকায় পাহাড় থেকে বরফ আসত। কিন্তু আমরা যেগুলো কিনতাম এক দুই সের করে মেপে, সেগুলো মোটেও পাহাড়ের ছিল না, কলে তৈরি। আরেকটি বিষয় ছিল, ঢাকার ইফতারি। খুবই মজার ছিল আমার কাছে। ইফতারিতে পুদিনা পাতা, লেবু, ধনেপাতা মেশানো হতো। বিক্রেতারা বলতেন তাজা খায় রাজা। ইফতারিতে থাকত পেঁয়াজু, বেগুনি, শামি কাবাব, সুতি কাবাব। এখনো মুখে লেগে আছে।

আমরা থাকতাম কলতাবাজারে। সেখানে শেষ রাতে গান গেয়ে গেয়ে সাহরির জন্য ডাকা হতো। রাস্তা দিয়ে গান গেয়ে গেয়ে যাচ্ছে, এটা খুব ভালো লাগত। তখন ঢাকায় বেশ ভিক্ষুক পাওয়া যেত। তারা বাড়িতে বাড়িতে আসত। আজকাল কিন্তু কমে গেছে। এখন রাস্তার মোড়ে, যেখানে সিগন্যাল পড়ে, সেখানে এসে দলবেঁধে দাঁড়ায়; কিন্তু বাড়িতে বাড়িতে আসে না। কয়েক বছর আগে, প্রবাসী এক আত্মীয় কিছু টাকা দিয়েছিল যাতে রমজানে একজন ভিক্ষুককে ইফতার ও সাহরি খাওয়াই। কিন্তু প্রথম বছর পেলাম, যদিও নানা শর্ত মেনে নিয়ে; দ্বিতীয় বছর আর পেলাম না! আসলে গোটা সমাজই আর্থিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ঈদের সময় বিদেশ থেকে টাকা আসে। মানুষের বাজার করার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, বিদেশ থেকে টাকা পেয়েছে। আমার বউমাও ঈদে ডলার পাঠিয়ে দেয়।

রমজানে ইফতারি, সাহরির খাবার দেখলেই বোঝা যায়, কতটা পরিবর্তন এসেছে। এখন ইফতারিতে ইন্দোনেশিয়ান খাবার, আমেরিকান খাবার, মধ্যপ্রাচ্যের খাবার পরিবেশিত হয়। আরেকটি কালচার ডেভেলপ করছে। সাহরির দাওয়াত দেওয়া। ইফতারির দাওয়াত আগে থেকেই ছিল। সাধারণ মানুষ থেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী দাওয়াত দেন। সেই দাওয়াত আমিও পাই। একবার র‌্যাব থেকেও ইফতারির দাওয়াত পেয়েছি! কিন্তু সাহরির দাওয়াত একেবারে নতুন। সাহরি করে মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে তারপর বাসায় ফেরা। নতুন চালু হয়েছে তরুণ-তরুণীদের ‘সাহরি পার্টি। গভীর রাতে রেস্টুরেন্ট গমগমে। দলবেঁধে সবাই সাহরি খায়। এখন মোবাইল ও পিসিতে স্কাইপি থাকার ফলে প্রবাসে থাকার বঞ্চনাও মানুষের কমছে। এতে করে ইফতারি বা সাহরির সময়, ঈদের দিন সবাইকে তো বটেই, খাবারের টেবিলে কী কী আছে, তাও দেখা যায়। এখন যেভাবে ঈদের দিন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সাধারণ লোকজনকে সাক্ষাৎ দেন, সেটাও কিন্তু বেশি দিন আগের নয়। কেবল ঈদে নয়, দুর্গাপূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমাতেও তারা এটা করেন। আমার ভালো লাগে।

আমাদের সময় ঈদি রেওয়াজ ছিল না। এই দুঃখ সহজে যাবে না। এত সালাম, এত মুরব্বি; কিন্তু একটা টাকাও পাইনি। একবার আব্বা এক টাকা দিয়েছিলেন; কিন্তু আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরে আরও আট আনা দিয়েছিলেন। আম্মা যত দিন বেঁচে ছিলেন তত দিনে ঈদি চালু হয়ে গেছে। জামাইরা পেত দশ টাকা, নাতীরা পাঁচ টাকা। ২৪ বছর পর নাতীরা বলল, এই এক রেট চলবে না। কারণ মুদ্রামান কমে গেছে। আম্মা এত রেট- ফেট বুঝতে গেলেন না; বললেন, যা নির্ধারিত হয়েছে, আর বাড়বে না।

আমার জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় ঈদ এসেছিল একাত্তরে। তখন কলকাতায় থাকি, জয়বাংলা পত্রিকায় কাজ করি। ঈদের আগের রাতে পার্থ সাহা এসে হাতে একশ টাকা গুঁজে দিলেন, ঈদ অ্যাডভান্স। সেটা দিয়ে পাঞ্জাবি কিনলাম, টুপি কিনলাম। পায়জামা ধুয়ে উড়িয়া লন্ড্রির দোকান থেকে ইস্ত্রি করে নিয়ে এলাম। জামাতে নামাজ পড়ে বের হলাম। তখন কলকাতায় আমার একজন মাত্র আত্মীয়া, আমার আপন ছোট খালার ননদ লিলি খালা। পাঠক চিনবেন তাকে জোহরা তাজউদ্দীন নামে। বহু কষ্টে ঠিকানা জোগাড় করে তার বাসায় গেলাম। সিকিউরিটিকে প্রথমে বললাম খালা হয় আমার, তারপর ভুল বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বললাম মাসী। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে ঢুকতে দিল। দরজা খুলে দিলেন, লিলি খালাই। ঢুকে দেখি ছোট্ট সোহেল তাজ লাল রঙের শেরোয়ানি, মাথায় রামপুরী টুপি। আমাকে দেখে বলল নমস্কার। কী যে মিষ্টি লাগল! কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি, কোনো ফিরনি নেই, নাশতা নেই। চাও দেয় না। একবার বললাম, অনেকক্ষণ ধরে চা খাই না। খালা বললেন, খালু তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশ, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কোনো অতিথি আপ্যায়ন চলবে না। খালু নিজেও থাকতেন তার অফিসে। নিজের হাতে কাপড়-চোপড় ধুতেন। এটা শুনে গর্বে আমরা বুক ভরে গেল। আমি ওই দিন নিশ্চিত হলাম, আমরা স্বাধীন হবই, ইনশাআল্লাহ।

আরেকটি ঈদ স্মরণীয় হয়ে আছে। আমি তখন জার্মান বেতারে কাজ করি। সেখানে কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। ঈদের আগের দিন নারী বস, ডরিস কোয়েটিংকে বললাম কালকে আমার ছুটি লাগবে। না ছুটি নেই। বললাম, তাহলে দেরি করে আসব। দুই ঘণ্টা পরে এসে দুই ঘণ্টা বেশি কাজ করে দেব।

তিনি বললেন, তা আগে বলিনি কেন। হবে না। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি ঈদের নামাজ খুব একটা পড়তাম না। বরং বোস কেবিনে গিয়ে সময় কাটাতাম। কিন্তু বিদেশে ওই যে দেশের সংস্কৃতির জন্য টান! রাগ করে ডরিসকে বললাম, দেখ আমাকে সেক্যুলারিজম শিখিয়ো না। আমাদের দেশে এক শতাংশ খ্রিস্টান তবু বড়দিনের ছুটি আছে। আর তোমাদের দেশে আট শতাংশ মুসলিম তবু ঈদের ছুটি নেই। ছুটি না দাও নাই, আমি ঈদের নামাজ সেরে তবে আসব। এই বলে নিচে গিয়ে কফি, সিগারেট খেয়ে আবার এসে কাজে বসেছি। ততক্ষণে গোটা অফিসে বিষয়টি রাষ্ট্র হয়ে গেছে এবং আমার ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। আফ্রিকানরা এসে, পাকিস্তানিরা এসে, ভারতীয়রা এসে আমার সঙ্গে কোলাকুলি করছে আর বলছে, তোমার প্রতিবাদ কাজে লেগেছে। আমার মনে হচ্ছিল, সেদিনই ঈদ।

 
Electronic Paper