কেমন কাটছে জেলে পল্লীর ৬৫ দিন
খায়রুল বাশার আশিক
🕐 ৯:৪৫ অপরাহ্ণ, মে ২৯, ২০১৯
গত কয়েক দিন আগে গণমাধ্যম থেকে জানলাম, ৬৫ দিনের জন্য বন্ধ করা হয়েছে জেলেদের সমুদ্রযাত্রা। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণের স্বার্থে ২০ মে থেকে শুরু করে আগামী ৬৫ দিন উপকূলের জেলেরা বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যেতে পারবে না, এমন সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সরকার। আগামী ২৩ জুলাই অবধি নিষেধাজ্ঞাকালে মৎস্য আহরণকারী কোনো ট্রলারকে সমুদ্রে যেতে না দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। এমন খবর দেখার পরই মনের মধ্যে কেমন একটা ব্যাথা অনুভব করলাম।
মুঠোফোনে কথা হলো কয়েকজন উপকূলীয় জেলের সঙ্গে। তারা জানালেন, সরকারের এমন চিন্তাকে অহেতুক জেলেদের ওপর নির্যাতন হিসেবে দেখছেন উপকূলীয়রা। সহায়তার ঘোষণা বা বাস্তবায়ন ছাড়াই সাগরে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন জেলেরা। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
টানা ৬৫ দিনের এমন নিষেধাজ্ঞার ফলে চরম দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে সমুদ্রগামী ইলিশ জেলেদের মাঝে। পরিবারের ভরণপোষণ, জেলে পল্লীর শিশুদের লেখাপড়া, চলমান রমজান ও আসন্ন ঈদের খরচ জোগাড়ে পুরো জেলে পরিবারগুলো যখন হিমশিম খাচ্ছে ঠিক তখন আবার নতুন হতাশার মধ্যে দিন কাটানো শুরু হলো তাদের।
ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে এখন। বছরজুড়েই এমন ক্ষণের অপেক্ষায় থাকে জেলেরা। উপকূলীয় জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের ১৭-১৮ জেলার লাখ লাখ জেলে এই মৌসুমের এমন দিনে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রতীক্ষায় দিন গোনে। তারা তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকে বড় এক চালান মাছ ধরে আর্থিক কষ্ট লাঘবের আশায়। ট্রলার মালিক থেকে নেওয়া দাদন (অগ্রিম), এনজিও থেকে নেওয়া ঋণ এবং চড়া সুদের ধার-দেনা পরিশোধের জন্য ইলিশের এমন মৌসুম যেন জেলেদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়।
উপকূলীয় জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৎস্য অধিদফতরের নির্ধারিত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ইলিশের প্রধান মৌসুম। তবে জুনের মধ্যভাগ থেকে জালে ইলিশ মেলে। এ সময় তিন থেকে সাড়ে তিন মাস জেলেরা সাগরে ইলিশ ধরতে যায়। প্রতি বছর মোট আহরিত তিনের দুই অংশ ইলিশ ধরা পড়বে এ সময়েই।
২০১৫ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মৎস্য-২ (আইন) অধিশাখা-১০-এর অধীনে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মাছ আহরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ ও কঠিন আবরণযুক্ত জলজ প্রাণী বসবাসের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং মাছের মজুদ সংরক্ষণের স্বার্থ রক্ষার চিন্তাই ছিল এ আইনের মূল প্রতিপাদ্য। এরপর থেকে এতদিন সেই নিষেধাজ্ঞার কোনো বাস্তবায়ন ছিল না। তবে এ বছর হঠাৎ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ আইনের ওপর গুরুত্বারোপ করে তা বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ আহরণের জন্য ব্যবহৃত যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌযান চলাচল বন্ধ রাখতে বলা হয়। তবে স্থানীয় নদ-নদী এই নিষেধাজ্ঞা মুক্ত থাকবে।
এ বছর এমন নিষেধাজ্ঞার খবর জেলেদের কানে পৌঁছানোর পর থেকেই তারা এই ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। এতে জেলেদের মধ্যে দেখা দেয় অসন্তোষ। নিষেধাজ্ঞা মুহূর্তে উপার্জনহীন হয়ে পড়ার শঙ্কা থেকেই তারা সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করে আসছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে মৎস্যজীবীরা মানববন্ধন, সভা সমাবেশ করে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একাধিকবার স্মারকলিপি দিয়েও কোনো ফল না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা। আর এতকিছুর পরেও জেলেদের জন্য এখনো কোনো ধরনের সরকারি সহায়তার ঘোষণা আসনি।
উপকূলীয় একাধিক জেলার জেলে ও মৎস্যজীবীরা জানান, তারা মহাজন ও আড়তদারের থেকে আনা দাদনের টাকা পরিশোধ নিয়ে চিন্তিত। এরই মধ্যে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত জেলেদের জীবনের জন্য নির্যাতনের স্বরূপ। সমুদ্রে মাছ ধরতে না পারলে তাদের ঋণ শোধ করার কোনো উপায় নেই। হয়তো জেলেদের শেষ সম্বল জাল-ট্রলার বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে হতে পারে।
জেলেরা জানান, এবারের এমন নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও মা ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে এবং জাটকা নিধন বন্ধ করতে প্রতি বছর একাধিকবার দীর্ঘ সময়ের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে সে সময়গুলোতেও মাছ ধরতে পারে না জেলেরা। সর্বশেষ ঈদের এমন পূর্ব মুহূর্তে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো, এতে দিশাহারা হয়ে পরেছে প্রান্তিক জেলেরা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হলে বরগুনা জেলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানালেন, ‘এমন মুহূর্তে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে উপকূলের জেলেদের না খেয়ে থাকতে হবে। জেলেদের কোনো রকম সহায়তা না দিয়েই সরকারের এমন সিদ্ধান্তে জেলেদের দুর্দিনের শেষ থাকবে না।’
নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলেদের কোনো সহায়তা দেওয়া হবে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে মৎস্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাসুদ আরা মমি জানান, দেশের ১২টি জেলার ৪২টি উপজেলার নিবন্ধিত জেলেদের ৬৫ দিনে ৬৫ কেজি (প্রতিদিন এক কেজি) চাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, শিগগিরই জেলেরা এ চাল পাবে বলে আশা করি।
তার সঙ্গে কথা বলার পর আবার কথা হয় কয়েকজন জেলের সঙ্গে। নিবন্ধিত জেলেদের প্রতিদিন এক কেজি চাল দেওয়ার এমন সুসংবাদের পর একজন জেলে প্রশ্ন করে বসলেন, অনিবন্ধিত জেলেরা কী খাবে? অন্য এক জেলে কষ্টের হাসি হেসে বললেন, চাল ছাড়া জেলেদের ঘরে আর কোনো কিছু কি লাগে না? এমন প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। সত্যিই তো, প্রতিটি পরিবারে ১ কেজি চালই কি যথেষ্ট? দেশে নিবন্ধিত জেলের থেকে তো অনিবন্ধিত জেলে আরও বেশি, তাদের কি হবে?
ইলিশের ভরা মৌসুমে এমন নিষেধাজ্ঞা কতটা যুক্তি বহন করে তা বোধগম্য নয় জেলেদের। নিষেধাজ্ঞার ফলে উপকূলের লক্ষাধিক জেলে, শ্রমিক, আড়তদার, পাইকাররা বেকার হয়ে পড়বে আগামী দুই মাসের জন্য, যা প্রভাব ফেলবে জাতীয় অর্থনীতিতে। পাশাপাশি ঈদআনন্দ থেকেও বঞ্চিত হবে জেলে পরিবারগুলো।
খায়রুল বাশার আশিক : সংবাদকর্মী
[email protected]