ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কৃষক মরছে ধানে, তারা চড়ছেন গাড়িতে

নুরে রোকসানা সুমি
🕐 ১০:৪৪ অপরাহ্ণ, মে ২৪, ২০১৯

চলতি বোরো মৌসুমে দেশে ধানের আশাতীত ফলন হয়েছে। কিন্তু কৃষকের মধ্যে উচ্ছ্বাস-আনন্দের পরিবর্তে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। কারণ ধানের দাম কম। উৎপাদন খরচও উঠছে না। এ ক্ষোভে ধানক্ষেতে আগুন লাগিয়ে বা রাস্তায় ধান ঢেলে অভিনব কায়দায় প্রতিবাদ করছেন কৃষক। ধান চাষ করে কৃষক যখন এর খেসারত দিচ্ছেন, ঠিক তখনই দেশের ৮৮ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার হাতে গাড়ির চাবি তুলে দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা চলছে সচেতন মহলে।

 

খোদ কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকও কৃষকদের আশার বাণী শোনাতে পারেননি। তিনি বলছেন, এ মুহূর্তে ধানের দাম বাড়ানো খুবই কঠিন। তবে ধান রপ্তানির মতো ভিন্ন কিছু উপায়ের কথা তারা বিবেচনা করছেন। এতে ধানের দামের ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তিনি মনে করেন। মন্ত্রী বলেন, কিছুদিনের মধ্যে ধান কাটা শেষ হলেই ফসলের পরিমাণ দেখে রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দাম কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এবার আশাতীতভাবে ধান উৎপাদন বেশি হয়েছে। আমাদের টার্গেট ছিল এক কোটি চল্লিশ লাখ টন। সেখানে ১৩ লাখ টন বেশি হয়েছে। ২০১৭ সালে সরকারি ও বেসরকারি গুদামে আমদানিটাও বেশি হয়েছিল।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত বছর ধানের দাম মোটামুটি পাওয়া গিয়েছিল, সেজন্য এবারও কৃষক বেশি পরিমাণে উৎপাদনে যাবেন তা আগেই অনুমান করা যাচ্ছিল। তিনি বলেন, সরকারের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিট নিয়মিতভাবে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে। সরকারের কাছে ধান-চালের মজুদ কতটা রয়েছে, সে সংক্রান্ত তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটিও আছে, যাতে পরিস্থিতির বিবেচনা করে খাদ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আগাম সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।

অন্যদিকে, বাজার পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, সরকার সে ব্যাপারে অনুমান করতে পারেনি বলে মনে করেন অনেক অর্থনীতিবিদ। বিশ্লেষকদের মতে, সরকার যদি সে অনুমান করতে পারত, তাহলে এখন ধানের দাম নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা এড়ানো যেত। গত দুই তিন সপ্তাহ ধরে ধানের দাম, ধানক্ষেতে আগুন দেওয়া নিয়ে খবর প্রকাশিত হচ্ছে গণমাধ্যমে।

কৃষক ও ধানক্ষেতে আগুনের ছবি যখন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, ফেসবুকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে ঠিক তখন রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন অডিটোরিয়ামে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ৮৮ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার হাতে গাড়ির চাবি তুলে দেন। বিষয়টি নিয়ে চায়ের স্টল ও পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত সমালোচনা গড়িয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে প্রযুক্তি হস্তান্তর শীর্ষক প্রশিক্ষণ প্রকল্পের (৩য় পর্যায়ে) আওতায় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের গাড়ি বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি সরকারি এসব গাড়ি প্রযুক্তি স্থানান্তরের কাজে ব্যবহারের জন্য কৃষি কর্মকর্তাদের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে সব উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে গাড়ি প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, দেশে শিল্পায়নের ফলে কৃষি শ্রমিক দিন দিন কমে যাচ্ছে। এজন্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকার ৫০-৭০ ভাগ পর্যন্ত ভর্তুকি দিয়ে থাকে। কৃষি ও কৃষকের প্রয়োজনে যা যা দরকার, সব করা হবে। সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।

এদিকে কৃষিমন্ত্রীর এ গাড়ি প্রদানকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেছেন সচেতন নাগরিকরা। তারা বলছেন, ‘কৃষক যখন ধানে মরছেন, কর্মকর্তারা তখন গাড়িতে চড়ছেন’- এটি দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়।

সম্প্রতি টাঙ্গাইলে এক কৃষক তার ধানক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া ও ধানের দাম ৭০০-৮০০ টাকার আলোচনাটি শুধু গ্রামেই নয়, ঢাকা শহরেও হচ্ছে। ধানের আগুনের উত্তাপ এখন রাজপথেও। বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। এ নিয়ে সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছেন বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বাম রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীসহ সচেতন মহল। দেশের বিভিন্ন জেলায় কোনো না কোনো সংগঠন প্রায় প্রতিদিনই ধানের দাম বাড়ানোর দাবিতে মানববন্ধন করেই চলছে। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীও হতাশাগ্রস্ত কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পাশাপাশি সারা দেশের সংগঠনটির সাধারণ নেতাকর্মীও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইমদাদুল হক সুমন গত ১৯ মে নির্ধারিত ও ন্যায্যমূল্যে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আইনি (লিগ্যাল) নোটিস পাঠিয়েছেন। এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে হাইকোর্টে রিট করা হবে বলেও নোটিসে উল্লেখ করা হয়।

যদিও ক্ষেতে আগুন দেওয়ার ঘটনা কেন ঘটেছে, তা তদন্ত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সরকার কখনো চাইবে না আমাদের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হোক। শেখ হাসিনার সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ধানের দাম কম হওয়ায় কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে বিস্তর। এমনকি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সমালোচনা করেছেন খোদ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। খাদ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘কৃষকের সঙ্গে দয়া করে মশকরা করবেন না।’ স্ট্যাটাসে তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষমতা কি মানুষকে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দেয়? আমার জানা মতে, সুস্থ চোখ অন্ধ হতে সময় লাগে। কিন্তু মাত্র চার মাসে ধানের ভা-ার নওগাঁর গাঁও-গেরাম থেকে উঠে আসা খাদ্যমন্ত্রী গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে তার আন্তরিক সম্পর্ক ভুলে গেলেন! অন্ধ হয়ে গেলেন এসির ঠাণ্ডা বাতাসে। আপনি, আমি কৃষকের ভোটে, কৃষকের দয়ায় সংসদে এসেছি। আগুন দিয়েছে নিজের ক্ষেতে, আপনার পাঞ্জাবিতে দেয়নি। তাতেই সহ্য হচ্ছে না!’ সরকারি দলেরও অনেক নেতাকর্মী হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের স্ট্যাটাসের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

এ বিষয়ে খুলনার কৃষক জাফর বলেন, আস্তে আস্তে কৃষক ধানের আবাদ করা বাদ দেবে। দেশে ধান-চালের অভাব হয় না। কিন্তু বিদেশ থেকে এনে মজুদ করলে তো দাম কমে যাবে। বারবার কৃষকর মার খাচ্ছে। ধান লাগাতে যে খরচ, তা ধান বিক্রি করে ওঠে না। ফলে ধান চাষের প্রতি আমাদের আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে।

 
Electronic Paper