নজরুল ও বঙ্গবন্ধু
রশীদুন্ নবী
🕐 ৩:৩৯ অপরাহ্ণ, মে ২৪, ২০১৯
বাঙালি জাতিকে মুক্তির আলো দেখাতে, বাঙালির মনে স্বাধীনতার বীজ বপন করতে, জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে আপসহীন রণনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। তিনি তার ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’ কবিতায় বলেন : ‘কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ/ এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।’ এই কবিতায় মুক্তির পতাকা ধারণ করতে নজরুল যে জোয়ানের আহ্বান করেন, যে দিশারির কামনা করেন, বাঙালির জীবনে সেই দিশারি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)।
বাংলার ঘুমন্ত মানুষকে জাগানোর উদ্দেশ্যে ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে নজরুল আশাবাদ ব্যক্ত করেন ‘বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।’ নজরুলের এই আশাবাদকে পরবর্তীকালে বাস্তবে রূপদানের ক্ষেত্রে প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যে বাংলার স্বপ্নের রূপ নজরুল তার কাব্য, সংগীত, প্রবন্ধ প্রভৃতিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, বঙ্গবন্ধু সেই স্বাধীন বাংলায় নজরুলের উপস্থিতি অত্যন্ত জরুরি মনে করেন। ১৯৭২ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত দেশকে সাজাতে বঙ্গবন্ধু দেশের দায়িত্ব পাওয়ার পর যে বিষয়গুলো সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন তার মধ্যে নজরুল-প্রসঙ্গকেও তিনি গুরুত্ব দেন। তাই ছয় মাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক চেষ্টায় যেমন নজরুলের ‘চল্ চল্ চল্’ গানটিকে রণসংগীতের মর্যাদা দেওয়া হয়, ১৯৭২ সালে তেমনি তাকেও পুনর্বাসন করা হয় এই স্বাধীন বাংলাদেশে। ঢাকাস্থ নজরুল একাডেমির আয়োজনে স্বাধীন দেশে প্রথম নজরুল-জয়ন্তীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে নজরুল একাডেমি প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু তার বাণীতে উল্লেখ করেন, ‘নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার।’
স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করতে বাঙালিকে উদাত্ত আহ্বান জানান নজরুল। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালিকে মুক্তির ডাক দেন। তিনি বাঙালিকে মুক্ত করতে যে আহ্বান জানান তার বীজ নজরুল প্রোথিত করেন তার নানা রচনায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের যে মূল বিষয় তাতে নজরুলের রচনার যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়।
নজরুল তার ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধটি শেষ করেন যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে তা হলো : ‘এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির-আমাদের।’ নজরুল আমাদের যে পবিত্র মাতৃভূমি চিনিয়ে দেন, সে মাটিকে, দেশকে নিজেদের করে পাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু যে ডাক দেন, সেই ডাকই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শাসন-শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক অমর কাব্য রচনা করেন রমনার রেসকোর্স ময়দানে। দেশের মানুষকে তাদের অধিকার আদায়ে একত্র করতে সমর্থ হন তিনি। ইংরেজ শাসন শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট পাকিস্তান যে বাঙালিকে আপন বাংলায় মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবে না, স্বাধীনতার স্বাদ নিতে দেবে না, তা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হয় বাংলার মানুষ।
বাঙালি সার্বিকভাবে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। সব ক্ষেত্রেই নিজেদের এ অপমান বাঙালিকে তাদের স্বাধীন দেশের প্রয়োজনকে উসকে দেয় আর তারা এটাও বুঝতে পারে যে ধর্মের জালে নয়, বাঙালি সংস্কৃতির টানেই মানুষ একাত্ম হতে পারে। এ উপলব্ধিকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাঙালিকে শোনান মুক্তির বার্তা। সেই মুক্তি বার্তার ভাবসম্পদ রয়েছে নজরুলের রচনায় নানাভাবে।
বঙ্গবন্ধু কেবল দেশের স্বাধীনতার ডাক দেননি, দিয়েছেন মুক্তির ডাক। মুক্তির আহ্বান ছিল সব ধরনের অনাচার ও অন্যের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি। অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে সমৃদ্ধি অর্জনে এ দেশের মাটির কোনো বিকল্প ছিল না।
এর প্রমাণ মিলেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী এই ৪৭ বছরে। বাংলাদেশ এখন কৃষিতে সচ্ছল, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভে সমর্থ হয়েছে। এ দেশের ভূমি, শ্রম, শিল্প প্রভৃতি ব্যবহার করেও যে অসম নীতি পালন করছিল তৎকালীন পাকিস্তানের নীতি-নির্ধারক শ্রেণি, বাস্তবসংগত কারণেই বাঙালি তা মানতে পারেনি বলেই বাঙালির মুখপাত্র বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন এই অসম ব্যবস্থা থেকে মুক্তি। জনগণের পূর্ণ সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বাঙালিকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরিতে সুযোগ না দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক সত্তাতে আঘাত করা বাঙালি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তাই বাঙালির প্রাণের কথাই বঙ্গবন্ধু দৃঢ় প্রত্যয়ে তার ৭ মার্চের ভাষণে শুনিয়ে দিলেন বিশ্বের সম্মুখে। বাঙালি সার্বিকভাবে মুক্তি চায়। বঙ্গবন্ধু এই মুক্তির পথের সহযাত্রী করে নেন লক্ষ-কোটি বাঙালিকে।
নজরুল আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন জাতি-ধর্ম ভেদাভেদের বিরুদ্ধে। নিজের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে তার সব কর্মেই তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা।
কবিতা, গান, প্রবন্ধ প্রভৃতি সব মাধ্যমেই এ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নজরুল ছড়িয়ে দেন। তাই তো তিনি উচ্চারণ করেন : ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম/ হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি/ হিন্দু তাহার প্রাণ।’ একই মায়ের দুই সন্তান হিন্দু মুসলমানের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে শক্তিশালী করার জন্য সোচ্চার ছিলেন নজরুল। এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের ডাক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধু বলেন : ‘বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।’ ধর্মের চেতনায় অসাম্প্রদায়িকতাই শুধু নয়, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে জাতিগত ক্লেশও ভুলে যেতে আহ্বান করেন। আজীবন তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সমগ্র বাঙালির মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। পাকিস্তান ও ভারত দুটি রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার পরও দুটি ভূখণ্ডেই হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সম্প্রীতি বজায় রেখে জীবনযাপন করবে, সে আশাবাদ বঙ্গবন্ধু বরাবরই পোষণ করতেন, যা নজরুল- চেতনাতেও অত্যন্ত স্পষ্ট।
বঙ্গবন্ধু বাংলার বন্ধু, বাঙালির বন্ধু। বাঙালি জাতি তাদের মস্তকে বঙ্গবন্ধু নামক তিলক ধারণ করে বঙ্গবন্ধুকে নেতা নির্বাচন করেছে। বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে আস্থার সিংহাসনে রেখেছে বলেই তার এক কথায় জাতি মৃত্যুকে তুচ্ছ মনে করে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারপরও বঙ্গবন্ধুর চাওয়া ছিল, সর্বক্ষেত্রে বাঙালির জীবনে সুখ নিয়ে আসা, বিশ্বের দরবারে বাঙালিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেখা। তাই তিনি নির্দ্বিধায় ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন : ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই।’ অনুরূপভাবে নজরুলও তার শেষ ভাষণে বলেছিলেন : ‘বিশ্বাস করো, আমি কবি হতে আসিনি।’ তবুও নজরুল হয়েছিলেন বাঙালির প্রাণের কবি। বঙ্গবন্ধুও বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণের শেষাংশে বলেন ‘জয় বাংলা’। অন্যদিকে নজরুল ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধের শেষাংশে বলেন : ‘বাঙলার জয় হোক।’
জাতীয় সংগ্রাম ও সংকটে বাঙালি শক্তি পেয়েছে নজরুল-রচনা থেকে। অন্যায়ের কাছে, পরাধীনতার কাছে মাথানত না করে বাঙালিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মন্ত্রণা দিয়েছেন নজরুল। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন নজরুলের শিকল ভাঙার হাতিয়ারস্বরূপ। এ দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। বাঙালি যত দিন বাংলার আলো, বাতাস, মা ও মাটির ঐশ্বর্যে লালিত হবে, নজরুল ও বঙ্গবন্ধুকে তাদের মনের মণিকোঠায় স্থান দেবে পরম মমতায়।