‘সাম্যবাদী’র চেতনা
শামস্ আলদিন
🕐 ২:৫৮ অপরাহ্ণ, মে ২৪, ২০১৯
নজরুলের সাম্যবাদী চেতনার আদর্শ ছিল আলাদা। তিনি দেখেছেন ভারতবাসীর ওপর শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নির্মম অত্যাচার এবং শোষণকে। এই উদ্দেশ্যের পথে শ্বেতাঙ্গরা সঙ্গে নিয়েছে ভারতবর্ষীয় জমিদার-মহাজনদের। ধর্মধ্বজাধারীরাও তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরীহ মানুষের ওপর উৎপীড়ন চালিয়ে নিরন্ন এবং অসহায় করেছে। এই অসাম্য দেখে নজরুলের কবি হৃদয় হাহাকার করে উঠেছে। তাই জনদরদি রোমান্টিক কবি সাম্যবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে কাব্যকাননে। মানুষকে উদ্ধারের বিপ্লবের মন্ত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।
একদিকে যেমন বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের পরিচয় রেখেছেন এবং অসহায় মানুষদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করতে সাম্যের গান শুনিয়ে বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে একটি কোমল হদয়ের সন্ধান দিয়েছেন।
তেমনি সর্বমানবের মুক্তি এবং সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা নজরুলের যেমন উদ্দেশ্য তেমনি মার্কসেরও উদ্দেশ্য। তবে পার্থক্য শুধু আদর্শগত। নজরুল মার্কসের মতো বস্তুবাদী ছিলেন না। মানবসমাজের ইতিহাসকে অর্থনৈতিক দিক থেকে আলোচনাও করেননি। কেবল সোচ্চার ছিলেন ধর্মীয় সাম্য ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে। শ্রমজীবী মানুষদের শ্রেণি সচেতন করে তোলার বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাও তার নেই। নজরুল সমাজতাত্ত্বিক বা দার্শনিক নন। শেষ পর্যন্ত তিনি কবি। তাই তার সাম্যবাদ মানবদরদি কবির সাম্যচিন্তা।
এ কাব্যে ফুটে উঠেছে তার অসাম্প্রদায়িক অগ্নিচেতনা। সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতাকে পুড়িয়ে তিনি সমগ্র বিশ্বের ধর্মমত সব মানুষকে অতি আপনার করে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। যেখানে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ আগুন থাকবে না, শ্রেণি-বৈষম্য থাকবে না, শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না।
সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতা ‘সাম্যবাদী’-তে কবি সাম্যের গান শুনিয়ে হিন্দু বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান-সাঁওতাল-ভীল-গারো-কনফুসিয়াস ও চার্বাকপন্থী সব সম্প্রদায়ের মানুষকে ধর্মের বিভেদ বৈষম্য ভুলে যেতে বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন কোরআন-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ পাঠ কেবলমাত্র পণ্ডশ্রমের নামান্তর। পুঁথি ঘেঁটে ঈশ্বরকে পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের হৃদয়ই সব দেবতা-যুগাবতারদের বিশ্ব দেউল। সেই হৃদয়ের ঠাকুরকে ভুলে কেবল বাইরের আড়ম্বর দিয়ে পূজার আয়োজন! মানব হৃদয়ে নিত্য বিরাজমান ঈশ্বরকে দেখতে হলে মনের সব সংকীর্ণতা ভুলে যেতে হয়। ছিন্ন করতে হয় স্বার্থের নাগপাশ বন্ধনকে।
সব তীর্থের সার এই হৃদয় মন্দির। এই তীর্থস্থানে ভ্রমণ করলে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, বুদ্ধ-গয়া, জেরুজালেম, মদিনা, কাবায় আরধনা করতে যেতে হয় না। এই মনমন্দিরে সাধনা করেই সত্যের সন্ধান পেয়েছেন ঈশা-মুসা, মেষের রাখাল, শাক্যমুনি। তাই আজ কবির বিশ্বাস-‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নাই।’ হিন্দু-মুসলিম-গ্রিক ইত্যাদি পুরাণের সঙ্গে ঘটনা চরিত্রের উপস্থাপনায় কবি তার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন।
সাধারণ মানুষকে অপমান ও অত্যাচার করবার জন্য যে বাবু চাতুরতা জীবনের ব্রত হয়, ‘সাম্যবাদী’ কবিতা তার মূল আঘাত হেনেছে। এক-একটা ধর্ম এক-একটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুহা তৈরি করে মানুষকে বেঁধে রাখতে চায় শৃঙ্খলায়। নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কবিতা সেই শৃঙ্খলার ওপর জাগরণের আঘাত। সমাজ সংস্কারের প্রতিক্রিয়ায় রচিত নজরুলের সাম্যবাদী। ক্ষুদ্র মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা নয়, ধর্মীয় ঔদ্ধত্যকে মেনে নেওয়া নয়, বরং জীবনের সব মূল্যে তাদের প্রতিষ্ঠাই নজরুলের কবিতার লক্ষ্য। ‘সাম্যবাদী’ পাঠের সময় মনে পড়ে যায় সপ্তদশ শতাব্দীর দৌলত কাজীর লেখা মানববন্দনা-নর বিনে নাহি চিন কেতাব কোরান/ নর সে পরম দেব তন্ত্র মন্ত্র জ্ঞান/ নর সে পরম দেব নর সে ঈশ্বর/ ত্রিভুবনে নাহি কেহ তাহার সমান। অর্থবণ্টনের বৈষম্যে নজরুলও সমাজবন্ধনের পুরানো কাঠামো ভাঙতে প্রায় একই সুরে লিখলেন, ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’
মানুষের ও সমাজের মূল্যবোধ পরিবর্তনের অনুপ্রাণিত ঢেউ। নজরুল খেটে-খাওয়া মানুষের জয়ধ্বনি করেছেন। আর এই জয়ধ্বনি থেকে পরবর্তী বাংলা কবিতায় নবযুগের অধিকারবোধে এসেছেন একে একে সুকান্ত ভট্টাচার্য, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাঠ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরুন মিত্র, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তরা। যার ফল, সাম্যবাদী চিন্তাধারায় আরও পরিপুষ্টি। বৈজ্ঞানিক যুক্তি-তর্কের ওপর নির্ভর করে নয়, নিজস্ব চিন্তা-চেতনার বশবর্তী হয়ে সমাজের সর্বস্তরের অসাম্যের প্রতি বিরোধিতা করতে গিয়ে, নজরুল সাম্যবাদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন।
মনে করেন, বিশ্বে যা কিছু কল্যাণকর, যা কিছু পাপ-তাপ-বেদনা-অশ্রুবারির কারণ তার অর্ধেক ঘটেছে পুরুষের জন্য, বাকিটা নারীর জন্য। কিছু স্বার্র্থান্বেষী, ধড়িবাজ পুরুষরা নারীদের ‘নরককুণ্ড’ বলে অপমান করে। এ বিশ্বে যত ফুল, ফল ফলেছে, রূপ, রস, গন্ধ, মধু, নির্মলতায় ভরেছে সবই নারীর দান। অথচ পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারী চরম অবমাননার শিকার হয়েছে। কবি স্মরণ করিয়ে দিতে চান জগতের সব সৃষ্টি, সব সৌন্দর্যের অন্তঃস্থলে এক সতীলক্ষ্মী বিরাজ করে। শুচি না হলে তাকে দেখা যায় না।
নজরুলের কবিতার প্রধান বিষয় বিপ্লব আর সাম্যবাদ। যুগ-চেতনা তাকে বিপ্লবের মন্ত্র শিখিয়েছে আর সামাজিক বৈষম্য তাকে সাম্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রাসী করে তুলেছে।
সমতার স্রোত এবং তার ছন্দে এইভাবেই নজরুল স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছেন। ‘সাম্যবাদী’ আসলে সর্বহারা শ্রেণির সংস্কৃতির স্বপক্ষে-দেশ বিশ্লেষণ, মানব-বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি তার নিজেকে বিশ্লেষণ। যে কারণে ‘সাম্যবাদী’ নজরুলের চেতনা অগ্নির অসাধারণ সৃষ্টি যেমন তেমনি বাংলা কাব্যসাহিত্যেও এ কাব্যগ্রন্থের মর্যাদা ভিন্ন ও সুউচ্চ এবং নিঃসন্দেহে কালজয়ী।