ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সেকেন্ড গডের সন্ধানে!

মাসুদ কামাল হিন্দোল
🕐 ৯:৪১ অপরাহ্ণ, মে ১৪, ২০১৯

পৃথিবীতে আমাদের মতো অনেকেই বিশ্বাস করেন আল্লাহ বা ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। আমেরিকানরা ধর্ম সম্পর্কে উদার মনোভাব দেখালেও আমেরিকান ডলারে লেখা আছে ডব We trust in God অর্থাৎ, আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। (আমেরিকা দ্বিতীয় গডের গায়ে প্রথম গডের বিশ্বাসের কথা ছাপার অক্ষরে তুলে ধরেছে)। কিন্তু ভোগবাদী সমাজে আরও একজন ঈশ্বর আছেন। তার নাম সেকেন্ড গড। ইংরেজিতে বলা হয় Money is the second God অর্থাৎ, টাকা হলো দ্বিতীয় দেবতা বা ঈশ্বর। এবং সে ‘গড’ বা দেবতার পরশ কমবেশি প্রায় সব মানুষই পেতে চায় এ জীবনে। অনেকে প্রথম গডের সন্ধান না করলেও দ্বিতীয় গডের সন্ধান ঠিকই করেন। কারও কারও এ গডের ছোঁয়া পেতে ধর্মান্তরিত, দেশান্তরিত বা দ্বীপান্তরিত হতেও আপত্তি নেই।

বঙ্কিম চন্দ্র লিখেছেন, ‘মুদ্রা মনুষদিগের পূজ্য দেবতাবিশেষ। মনুষ্য যত দেবতার পূজা করে, তন্মধ্যে ইঁহার প্রতিই আমাদের বিশেষ ভক্তি। ইনি সাকার। স্বর্ণ, রৌপ্য এবং তাম্ম্রে ইঁহার প্রতিমা নির্মিত হয়। লৌহ, টিন এবং কাঠে ইঁহার মন্দির প্রস্তুত করে। রেশম, পশম, কার্পাস, চর্ম প্রভৃতিতে ইঁহার সিংহাসন রচিত হয়। মনুষ্যগণ রাত্রিদিন ইঁহার ধ্যান করে এবং কিসে ইঁহার দর্শনপ্রাপ্ত হইবে, সেই জন্য সর্বদা শশব্যস্ত হইয়া বেড়ায়। (সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-‘রাখিস মা রসেবসে’ পৃ ১৫৩)।

গডকে কি কেউ দেখেছেন? বা তার সন্ধান পেয়েছেন? এর উত্তর ‘না’ (গডকে উপলব্ধি করতে হয় মনে-প্রাণে-ধ্যানে)। কিন্তু সেকেন্ড গড নাকি আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়ায়, হাত বাড়ালে ধরা যায়। আমাদের নেটওয়ার্কের মধ্যেই তার পদচারণা। শুধু তাকে ধরতে জানতে হয় কায়দা মতো। সেকেন্ড গডকে পাওয়ার জন্য সবাই ব্যস্ত। আমি তুমি সে। আমরা সবাই। টাকা ছাড়া এখন কোনো কথা নেই। টাকাটাই সব কথা, বাকি সব বাতুলতা। ফালতু কথা, কথার কথা। এর জন্য জীবন বাজি রাখতেও রাজি। এ পৃথিবী কিসের বশ? এর উত্তর হলো অর্থের বশ। এখন প্রশ্ন উঠেছে টাকা বড়, না দেশপ্রেম। এর উত্তর টাকা। আমাদের দেশপ্রেম হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেছে অনেক আগেই।

মুখে অনেকেই টাকা অতি তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলিয়া থাকেন। কিন্তু জগৎ এমন ভয়ানক স্থান যে টাকা না থাকিলে তাহার স্থান কোথাও নাই। সমাজে নাই, স্বজাতির নিকট নাই, ভ্রাতা-ভগিনীর নিকটে নাই, স্ত্রীর নিকটে নাই। স্ত্রীর ন্যায় ভালোবাসে এমন বলতে জগতে আর কে আছে? টাকা না থাকিলে অমন অকৃত্রিম ভালোবাসারও আশা নাই। কাহারও নিকট সম্মান নাই। টাকা না থাকিলে রাজায় চিনে না, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তে টাকা, জগৎ টাকারই খেলা।’ (মীর মশাররফ হোসেন বিষাদ সিন্ধু)।

এ অবস্থায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের টাকার কুমির বানাতে প্রলুব্ধ করছে। গাড়ি ঘোড়ায় চড়ার শিক্ষাকে উৎসাহিত করছে। সেকেন্ড গডের পেছনে ছুটতে প্রণোদনা জোগাচ্ছে। সেকেন্ড গডের সন্ধানে সবাই মত্ত। যে কোনো মূল্যে সেকেন্ড গডের সঙ্গ পেতে হবে। সেকেন্ড গড এখন ভোগবাদী চরিত্র নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত। সেকেন্ড গডের আহ্বানকে আমরা উপেক্ষা করতে পারছি না। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেদিকে ধাবিত হচ্ছি ভেড়ার পালের মতো। ভোগবাদের অশুভ প্রতিযোগিতায় সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থ এখন হয়ে গেছে সুখের সমার্থক। সুখ কিনতে অর্থ লাগে। অনেক অনেক অর্থ। তাই সুখী হতে চাইলে সেকেন্ড গডের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে তুলতেই হবে। কিন্তু সাধক সলোমান বলেছেন, ‘রাতারাতি বিত্তশালী হওয়ার পেছনে যে অগ্রসর হয়, সে অপরাধশূন্য থাকতে পারে না।’ এ কথা জানে সবাই, মানে কয়জন? জেনে-শুনেই তারা সেকেন্ড গডের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। সেকেন্ড গডকে কাছে পাওয়ার মোহ ‘নেটওয়ার্ক সমাজে’ ফেসবুক অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফেসবুকে অন্যের সাফল্য দেখে দেখে নিজের সঙ্গে তুলনা করছে। একই সঙ্গে বাড়ছে সেকেন্ড গডকে পাওয়ার আকুতি।

সেকেন্ড গডের খোঁজ পেতে মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা, ইন্টারনেটে মেইল আসে। সেই সূত্র ধরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অনেকেই। বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিনে অনুসন্ধান করেন। সেকেন্ড গডের সন্ধানে যারা মেতে আছেন তারা প্রতারিতও হচ্ছেন। তবুও তারা ছুটছে বিরতিহীন। সেকেন্ড গডের দেখা খুব সহজে পেতে বাজারে অনেক বইপুস্তকও পাওয়া যায়। কোনো কিছু পেতে হলে সাধনা ধৈর্য পরিকল্পনা লাগে। কিন্তু সেকেন্ড গডের আরাধনায় যে বা যারা ব্যতিব্যস্ত তাদের হাতে এত সময় কই সময় নষ্ট করার। তারা সবাই আলাদিনের প্রদীপ প্রত্যাশী। এক রাতের মধ্যে সব বদলে ফেলতে চায় চেরাগে ঘষা দিয়েই। সেকেন্ড গডের সঙ্গ পেতে গডকে বাদ দিয়ে তথাকথিত গডসদের সাহায্য-সহযোগিতা নিতে তাদের আপত্তি নেই।

সেকেন্ড গডের আসক্তিটা এত প্রবল যে, সে মানুষকে অন্যদিকে তাকাতে দেয় না। কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে দেয় না। নিজের দৃষ্টি নিজের দিকে আবদ্ধ রাখতে বাধ্য করে। সব ভুলিয়ে দেয়। ঘোরের মধ্যে রাখে। ন্যায়-অন্যায় সমার্থক মনে হয়। শুধু তার (সেকেন্ড গডের) পেছনে ছুটতে অনুপ্রাণিত করে। এভাবে তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ছুটছি কেন? কেউ জানি না, যাচ্ছি কতদূরে? এভাবে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। গডের সাহচর্য পেতে সবকিছু করতে পারে। তার সঙ্গে মিতালি গড়ে উঠে শুধু অর্থের। জীবনের জন্য প্রয়োজন সাড়ে তিন হাত মাটিকেও সে উপেক্ষা করে। এ দর্শনে বিশ্বাস করেন এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

টাকাকে সেকেন্ড গড মনে করলে বিপর্যয় অনিবার্য। এই গডের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা উচিত। কিন্তু উল্টো সেকেন্ড গডকে কাছে পাওয়ার জন্য আমরা সব কিছু এক এক করে ধ্বংস করছি। এক সময় হয়তো আমাদের হাতে অনেক অনেক টাকা বা অর্থ থাকবে। বড় বড় অঙ্কের লাখ বা মিলিয়ন ডলারের নোটও থাকবে। কিন্তু সেদিন জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ পানি, ভেজালমুক্ত খাদ্যদ্রব্য, বিশুদ্ধ আলো-বাতাস কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না (কেনিয়াতে রাজনৈতিক সংকটের কারণে ঘরভর্তি টাকা দিয়েও একটা পাউরুটি কেনা যায়নি)। আমরা সবাই সেই অবস্থার দিকেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি চোখ কান বন্ধ করে। সে সময় সেকেন্ড গডকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে থাকতে হবে প্রথম ও একমাত্র গডের প্রার্থনায়।

মাসুদ কামাল হিন্দোল : সাংবাদিক ও রম্যলেখক
[email protected]

 

 
Electronic Paper