চা শ্রমিকের মানবেতর জীবন
আশফাক রহমান
🕐 ১২:৪৮ অপরাহ্ণ, মে ০২, ২০১৯
এ দেশে চায়ের দীর্ঘ ইতিহাসের ভেতরই ভারত ভাগ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু চা শ্রমিকদের ভাগ্য চা বাগানের হাড়ভাঙা খাটুনির গ-িতে বাধা পড়ে আছে। বংশানুক্রমে সমাজের মূলধারা থেকে বিছিন্ন এই মানুষগুলোর নিজেদের ভূমির অধিকার নেই, দিনে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা মজুরির চক্রে বাঁধা এদের জীবন। বৃহত্তর সিলেট এলাকার দেড় শতাধিক চা বাগানে কর্মরত আছে এক লাখ আঠারো হাজার চা শ্রমিক। ইংরেজ আমলে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই শ্রমিকরা মাইলের পর মাইল পাহড়ি টিলা আর ঢাল পরিষ্কার করে চা বাগানের সূত্রপাত করেছিল। বিনিময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই মানুষেরা চা শ্রমিকের কাজটিই করে যাচ্ছে।
আজ থেকে বহু বছর আগে ব্রিটিশ শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগমন ঘটে তাদের। এরপর থেকে বংশ পরম্পরায় তারা কাজ করছে চা বাগানে। চা শ্রমিকের মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতোই চা মালিকের বাগানের সঙ্গে বাঁধা তার নিয়তি। চা বাগানে পাতা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ৬৪ শতাংশ শ্রমিকই হচ্ছেন নারী। চা শ্রমিক নারীদের দিন শুরু হয় সেই কাকডাকা ভোরে। প্রতিটি নারী শ্রমিককেই তাড়াহুড়া করে গৃহস্থালীর কাজ শেষ করে, ছোট ছোট সন্তানদের রেখে দলবেঁধে ছুটতে হয় বাগানপানে। এক চিমটে লবণ চা দিয়েই সকালের যাত্রা শুরু হয় চা শ্রমিকের। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়-তুফান সবকিছু মাথায় নিয়েই কাজে থাকতে হয় শ্রমিকদের। নারী শ্রমিকরা শুধু পাতি (চা-পাতা) উত্তোলনের কাজই করেন না, তারা কলম কাটা, চারাগাছ রোপণ থেকে শুরু করে গাছের আগাছা পরিষ্কার করার কাজেও নিয়োজিত থাকেন।
অথচ এসব নারী শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদাসীন বাগান মালিকরা। নেই তাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুব্যবস্থা। বাগানে কর্মরত প্রায় নারীকেই দেখা যায় রক্তশূন্যতা, স্বাস্থ্যহীনতা, জন্ডিস, ডায়রিয়া, জরায়ু ক্যান্সারসহ নানা রোগে ভুগতে। অসচেতনতা, নোংরা পরিবেশ, পরিচ্ছন্ন পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব, অপুষ্টিকর খাবার, নালা ও খালের পানির ব্যবহার, বাল্যবিয়ে, বেশি সন্তান নেওয়া, নিয়ন্ত্রণহীন যৌনাচারসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবই তাদের মূলত এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ।
চা শ্রমিকদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী প্রাথমিকভাবে জরায়ুমুখে ক্যান্সারে আক্রান্ত-এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে গবেষণামূলক সংস্থা সিআইপিআরবির এক জরিপে। এতে দেখা গেছে, দেশের মোট ১৬৪টি চা-বাগানে প্রায় ৯ লাখ শ্রম-জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী শ্রমিক। এই অর্ধেক নারী শ্রমিকের ১৫ শতাংশের শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার।
একজন চা শ্রমিক দৈনিক যে মজুরি পান তা দিয়ে চিকিৎসা করানো দূরের কথা, পরিবারের খরচ জোগানোই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেওয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনটাও তেমনি ছেঁটে দেওয়া চা গাছের মতো, লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁঁড়েঘরে বন্দি। এই জীবন অবশ্যই এই সভ্যভব্য সমাজে কম্য নয়।