ডিএনএ আবিষ্কারক
রাশেদ আহমেদ
🕐 ৩:২৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৭, ২০১৯
রোজালিন্ড এলজি ফ্রাঙ্কলিন একজন ব্রিটিশ ভৌত রসায়নবিদ ও কেলাসবিজ্ঞানী। যিনি ডিএনএর আণবিক কাঠামো আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ফ্রাঙ্কলিন যুক্তরাজ্যের লন্ডনের নটিং হিল এলাকাতে একটি সচ্ছল ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি সেন্ট পলস গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৩৮ সালে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউনাম কলেজে ভৌত রসায়ন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন ও সেখান থেকে ১৯৪১ সালে স্নাতক লাভ করেন।
পরবর্তীতে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভৌত রসায়নে গবেষণা করার জন্য একটি ফেলোশিপ বৃত্তি লাভ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার কর্মজীবনের গতিপথ বদলে যায়। তিনি লন্ডনের একজন বিমান হামলা ওয়ার্ডেন হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন।
১৯৪২ সালে তিনি ফেলোশিপ ছেড়ে দেন এবং ব্রিটিশ কয়লা ব্যবহার গবেষণা সংস্থাতে যোগদান করেন। সেখানে তিনি যুদ্ধের স্বার্থে কার্বন ও কয়লার শোষণ ধর্মের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গবেষণাতে অবদান রাখেন ও এ ব্যাপারে পাঁচটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। পরে এই গবেষণাকর্মটির ওপর ভিত্তি করেই তিনি তার ডক্টরেট অভিসন্দর্ভটি রচনা করেন। ১৯৪৫ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট সনদ লাভ করেন। ১৯৫১ সালে ফ্রাঙ্কলিন লন্ডনের কিংস কলেজের জীবপদার্থ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারে ফেলো গবেষক হিসেবে একদল বিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগ দেন। সেখানে তিনি রঞ্জন-রশ্মি অপবর্তনের পদ্ধতিগুলো ডিএনএ-সংক্রান্ত গবেষণায় প্রয়োগ করেন, যা ছিল সম্পূর্ণ অভিনব একটি কাজ। সে সময় ডিএনএ-র রাসায়নিক গঠন ও কাঠামো নিয়ে তেমন কিছুই জানা ছিল না।
ফ্রাঙ্কলিন শিগগিরই ডিএনএর ঘনত্ব বের করেন। তিনি নিজের উদ্ভাবিত একটি কৌশল ব্যবহার করে ডিএনএর ছবি তোলেন এবং প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন যে ডিএনএ অণুর আকৃতি কুণ্ডলাকার। সে সময় অন্য কোনো বিজ্ঞানীই ডিএনএ অণুর এরকম চিত্র তুলতে সক্ষম হননি। এ ছাড়া ফ্রাঙ্কলিন ডিএনএ অণুতে ফসফেট চিনির অণুগুলোর অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম হন। ডিএনএর কাঠামো সংক্রান্ত যেসব তথ্য ফ্রাঙ্কলিন আবিষ্কার করেছিলেন, সেগুলো তার অজান্তে ও তার অনুমতি ছাড়াই উইলকিনস ১৯৫৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন বিজ্ঞানী- মার্কিন জীব রসায়নবিদ জেমস ওয়াটসন ও ব্রিটিশ জীব রসায়নবিদ ফ্রান্সিস ক্রিকের কাছে সরবরাহ করে দেন। ফ্রাঙ্কলিন ডিএনএ অণুসমূহের যে অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার রঞ্জনরশ্মি চিত্রগুলো তৈরি করেন, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে এবং নিজেদের খুঁজে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে ১৯৫৩ সালেই কয়েক মাস পরে নেচার নামক গবেষণা পত্রিকাতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ওয়াটসন ও ক্রিক প্রস্তাব করেন যে ডিএনএর গঠন একটি দ্বি-কুণ্ডলাকৃতি পলিমার, যেখানে দুটি ডিএনএ তন্তু একে অপরকে সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত ফ্রাঙ্কলিন জানতেন না যে তার গবেষণাকর্ম এভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। নেচার পত্রিকার ওই একই সংখ্যাতে উইলিকনস ও ফ্রাঙ্কলিন আলাদা আলাদা নিবন্ধ প্রকাশ করেন।
এরপর ফ্রাঙ্কলিন এ ব্যাপারে আরও পাঁচটি গবেষণাপত্র ছাপান। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ফ্রাঙ্কলিন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈশকালীন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বার্কবেক কলেজের কেলাসবিজ্ঞান পরীক্ষাগারে কাজ করেন। সেখানে তিনি কয়লা ও ডিএনএর ওপর তার গবেষণাকর্মগুলো সমাপ্ত করেন এবং তামাকের মোজাইক ভাইরাসের আণবিক গঠনের ওপর একটি প্রকল্প হাতে নেন।
অন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তার যৌথভাবে করা একটি গবেষণাকর্মে প্রমাণিত হয় যে ওই ভাইরাসের অভ্যন্তরস্থ রাইবোনিউক্লিয়িক অ্যাসিড (আরএনএ) ভাইরাসের ভিতরের গহ্বরে নয়, বরং এর প্রোটিনগাত্রের মধ্যে গ্রথিত থাকে। তারা আরও দেখান, এই আরএনএটি ছিল একটি মাত্র কুণ্ডলাকার তন্তুর ন্যায়, ব্যাকটেরিয়াসদৃশ ভাইরাস ও উচ্চতর জীবে প্রাপ্ত ডিএনএর মতো দ্বি-কুণ্ডলাকার তন্তুসমষ্টি নয়। জীবনের শেষপর্যায়ে ফ্রাঙ্কলিন জীবন্ত পোলিও ভাইরাসের কাঠামোর ওপর কাজ করছিলেন, যদিও এর ফলে তার নিজের পোলিও রোগে সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি ছিল।
তার মৃত্যুর পর এরকম ঝুঁকিপূর্ণ ভাইরাসকে নিয়ে গবেষণায় বিরতি দেওয়া হয়। ফ্রাঙ্কলিন ১৯৫৮ সালে ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর চার বছর পরে ১৯৬২ সালে মরিস উইলকিনস, জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক-কে ডিএনএর কাঠামো আবিষ্কারে অবদান রাখার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। অনেকে মনে করেন ফ্রাঙ্কলিন বেঁচে থাকলে তাকেও এই পুরস্কারের অংশীদার করা হতো।