ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

খালেদার প্যারোল যে কোনো সময়

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:১৭ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৫, ২০১৯

যে কোনো সময় প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সরকারের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে দরকষাকষি শেষে দলের চেয়ারপারসনকে জেলের বাইরে আনার সর্বশেষ চেষ্টায় সফল হচ্ছে বিএনপি। সরকার ও বিএনপির একাধিক সূত্রে এ খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই খালেদা জিয়ার প্যারোলের খবর আসতে পারে। তবে প্যারোলের বিষয়টিকে খালেদার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যেই মিলেছে এমন ইঙ্গিত।

সূত্র জানিয়েছে, আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদার মুক্তি যখন দীর্ঘসূত্রতায় আটকে গেছে তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত-সমঝোতার পথেই তার মুক্তির পথ খুঁজেছে বিএনপি। কারণ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কারান্তরীণ খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তার চিকিৎসা প্রয়োজন। প্যারোলে মুক্ত হয়ে তার ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি চিকিৎসা নিতে পারবেন। তবে প্যারোলে মুক্তি পেলে দেশে নয় খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসা করাতে পারেন বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব বা যুক্তরাজ্যে তিনি চিকিৎসার জন্য উড়ে যেতে পারেন।

যদিও প্যারোলে নয়, খালেদার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছিল বিএনপি। খালেদার প্যারোলে মুক্তি বিষয়টি আলোচনায় আসার পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিক সভায় বলেছেন, ‘নিঃশর্তভাবে দেশনেত্রীকে মুক্তি দিতে হবে। আমরা কোনো প্যারোলের কথা বলিনি।’ জামিন পাওয়া খালেদা জিয়ার অধিকার বলে মন্তব্য করে গত ৭ এপ্রিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গণঅনশন কর্মসূচিতে তিনি বলেন, ‘যে মিথ্যা মামলায় তাকে (খালেদাকে) সাজা দেওয়া হয়েছে, সেই মামলায় অন্য ব্যক্তিরা সবাই জামিনে রয়েছেন।’

খালেদার মুক্তির জন্য আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বানও জানান বিএনপি মহাসচিব। কিন্তু হঠাৎ করে ফখরুলের সে সুরে এসেছে পরিবর্তন। প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি দলের নয়, সেটা একান্তই খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। সোমবার জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নবগঠিত আহ্বায় কমিটির নেতাদের নিয়ে শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে তিনি মুখোমুখি হন সাংবাদিকদের।

পহেলা বৈশাখ রোববার বিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে ফখরুল বলেছিলেন তাদের নেত্রী গুরুতর অসুস্থ। সে সাক্ষাতে খালেদা জিয়ার প্যারোল নিয়ে আলোচনা হয়েছে কী না জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্যারোল আমাদের দলের বিষয় নয়। এটা বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের বিষয়। সুতরাং এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করি নাই।’

গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে তার জামিনে মুক্তির চেষ্টা করছেন আইনজীবীরা। এখনো তাতে সফল না হওয়ায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ বিএনপির অধিকাংশ আইনজীবী বলছেন, সরকার ‘না চাইলে’ আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়।

এমনই প্রেক্ষাপটে খালেদার আইনজীবী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন গত ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে সাংবাদিকদের সামনে খালেদা প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন বলে বক্তব্য দেওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে খালেদার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি। ওইদিন সাংবাদিকদের সামনে খন্দকার মাহবুব বলেছিলেন, দণ্ডিত হলেও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং খালেদা জিয়াকেও তা চাইতে হবে।

খন্দকার মাহবুবের এ বক্তব্যের পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে খালেদা জিয়া প্যারোলের আবেদন করলে তা খতিয়ে দেখা হবে। খন্দকার মাহবুব এর আগে গত বছরও খালেদার প্যারোলে মুক্তি দাবি করেছিলেন। সর্বশেষ খন্দকার মাহবুব বলেছেন, যখন একটি লোক চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তার চিকিৎসা দরকার। আর আইন অনুযায়ী আদালতে জামিন পেতে তার অনেক সময় লেগে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকার ইচ্ছা করলে তাকে প্যারোলে মুক্তি দিতে পারেন। চিকিৎসার জন্য দিতে পারেন। বিশেষ কারণেও দিতে পারেন। তবে এ সময় তিনি বলেন, খালেদার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

অবশেষে সে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন বলে জানাচ্ছে বিএনপির সূত্রটি। খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টির সঙ্গে বিএনপির সংসদে যাওয়ার বিষয়টি জড়িত বলেই জানা গেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গত ৩০ ডিসেম্বর একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারলেও সে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে ফলাফল বর্জন করে বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচনে ৩০০ আসনে মাত্র ৬টি আসন পায় বিএনপি। ঐক্যফ্রন্টের গণফোরাম পায় দুটি আসন। এ নিয়েই সংসদ বর্জন করার ঘোষণা আসে তাদের পক্ষ থেকে। কিন্তু এরই মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান সংসদে যোগ দিয়েছেন। বিএনপির তার ৬ সংসদ সদস্য নিয়ে সংসদে যাবে না বলে সাফ ঘোষণা দেয়। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতির পটও পরিবর্তিত হতে শুরু করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নানা সুবিধা ও ছাড় দিয়ে এ মুহূর্তে সংসদে আনার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে।

বিএনপিকে যে কোনো উপায়ে সংসদে নিতে পারলে নির্বাচন নিয়ে সব ধরনের প্রশ্ন থেকেই রেহাই পায় ক্ষমতাসীনরা। বিএনপিও ক্ষমতাসীন দলের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে প্রয়োজনীয় দর কষাকষি সেরে নিচ্ছে। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার পর থেকে দলটি মূলত স্মরণকালের সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ সময় অতিক্রম করছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান মামলায় সাজা নিয়ে বিদেশে পলাতক থাকায় দলের হাল ধরার মতো কেউ নেই। আইনিভাবে লড়াই করেও তারা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারেনি। প্রায় তিন ডজনের মতো মামলার পাহাড় ডিঙিয়ে খালেদা জিয়াকে আইনি প্রক্রিয়ায় জেল থেকে মুক্ত করা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করা হচ্ছে। তাই দলটির সামনে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। কারণ খালেদার মুক্তির বিষয়টিকেই তারা প্রধান কর্তব্য বলে মনে করছে। প্যারোলে মুক্তি পেলেও খালেদা জিয়া অন্তত দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝে থাকতে পারবেন। এতে দল গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাবে এবং খালেদা জিয়ার পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদের মনোবলও ফিরে আসবে। এসব চিন্তা করেই খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

তবে এ ক্ষেত্রে দলীয় সিদ্ধান্ত নয়, খালেদার ব্যক্তিগত মত ও পরিবারের লোকজনের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তার প্যারেলে মুক্তির পাশাপাশি বিএনপি ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কয়েকটি বিষয়ে দর কষাকষি সেরে নিচ্ছে। তার মধ্যে বিএনপির ছয় এমপিকে সংসদে নিতে হলে সরকারকে বিএনপির ওপর উপর্যুপরি নিপীড়ন বন্ধ করা, বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দান, অবাধে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে মূলত বিএনপির তরফ থেকেই আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গেছে সরকারের কাছে। যদিও বিএনপির কেউ তা স্বীকার করতে চাইছেন না। কয়েকটি দেশের দূতাবাসও খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। খালেদা জিয়ার পরিবারের লোকজনকে দিয়েই এ প্রস্তাব করানো হয়েছে। তবে এ প্রস্তাবে তারেক রহমানের সায় আছে কী না তা জানা যায়নি। বিএনপির শীর্ষনেতা বেশ কিছু দিন সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে দেন দরবার চালাচ্ছিলেন বলে জানায় সূত্রটি। কারণ- ইতোমধ্যে এর সঙ্গে বিএনপি সংসদে যাওয়ার প্রশ্নটি যুক্ত হয়ে গেছে।

তিন ডজনের মতো মামলায় জর্জরিত খালেদা জিয়াকে গত এক বছরেও জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতে না পারা এবং মধ্যে দুটি মামলায় দশ ও সাত বছরের সাজার ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা জেঁকে বসেছে। এর মধ্যে খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে তার পছন্দ অনুযায়ী বিশেষ হাসপাতালে চিকিৎসার দাবি জানায় বিএনপি। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। সম্প্রতি তার অসুস্থতা আরও বেড়ে গত ১ এপ্রিল তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। এখানেই তার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি গতি পায়।

অবশ্য জেল থেকে খালেদা জিয়া যে আসবাব ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিলেন তা দেখে অনেকেই অনুমান করেছিলেন, এ যাত্রায় তিনি দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকবেন নতুবা প্যারোলে মুক্তি পাবেন। আর্থ্রাইটিসসহ নানা রোগে ভুগলেও ওই দিন খালেদা জিয়াকে অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেকটা চাঙ্গা ও ফুরফুরে মনে হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

খালেদাকে হাসপাতালে আনার পর থেকে বিএনপির আন্দোলন তৎপরতা যেমন বেড়েছে তেমনি সংবাদ ব্রিফিংয়ে তাদের বক্তব্যও আগের চাইতে আক্রমণাত্মক হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে। এ সময়েই খালেদার মুক্তির দাবিতে গণঅনশনের কর্মসূচি দেয় বিএনপি।

এমনকি বিএনপি পুরনো জোট ২০ দলীয় নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে অনেকটাই এ আভাস পাওয়া যাচ্ছিল, যে কোনো সময় খালেদার প্যারোলের মুক্তির খবর আসতে পারে।

 

 
Electronic Paper