বিদায়ী বছরের অর্থনীতির হালচাল
প্রবৃদ্ধিতে বড় অর্জন শঙ্কা ব্যাংক খাতে
নাজমুল হুসাইন
🕐 ১০:৩০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০১৯
প্রবৃদ্ধির বড় অর্জন নিয়ে শেষ হচ্ছে আরেকটি বাংলা বর্ষ। এ বছর বিশ্বের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তালিকায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। যদিও এ প্রবৃদ্ধিকে টেকসই রাখতে এখনো সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত, যা কয়েক বছর ধরেই দেশের অর্থনীতির অন্যতম দুর্বল খাত হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। পুরো ব্যাংক খাতে ভয়াবহ অব্যবস্থাপনা, অস্থিরতা ও সংকট শঙ্কিত করে তুলেছে অর্থনীতির ভবিষ্যৎসহ সাধারণ মানুষকেও।
তথ্য বলছে, দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছর ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাথমিক প্রাক্কলন হচ্ছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির আয়তন এই হারে বেড়েছে। অন্যভাবে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি নির্দেশ করছে, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে।
৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন দেশের জন্য নিশ্চিতভাবে এ বছরের সেরা অর্জন। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছে। যদিও প্রবৃদ্ধি টেকসই রাখতে সংস্কারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি মনে করে, ব্যাংক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম দুর্বল খাত। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ দিচ্ছে, আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। রাজস্ব আদায়ে জোর দিতে হবে।
শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিবেদনেও ব্যাংক খাত নিয়ে একই রকম বিপদের কথা বলা হয়েছে। দুটি সংস্থাই জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলছে। বাংলাদেশের সরকারও বিষয়টি নিয়ে নড়ে চড়ে বসছে। এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ঋণখেলাপিরা ঋণ শোধ না করলে ৯ শতাংশ হারে সুদ নেওয়া হবে। যদিও এরপর অর্থমন্ত্রীর এ প্রক্রিয়ায় প্রকৃত খেলাপি ঋণ কমবে না বরং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হবে বলে মতামত দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের কথায়, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে দেশে। প্রথম পর্যায়ে গুরুতর অনিয়ম ও বিচ্যুতিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এখন ব্যাংকিং খাত সংকটের চরম পর্যায়ে রয়েছে। প্রথমদিকে যখন সোনালী ব্যাংকে হলমার্কের মতো কেলেঙ্কারি ঘটল, তখন থেকেই খেলাপি ঋণ নজরে আসতে পারতো। কিন্তু এর পরেও বেসিক ব্যাংকের মতো ভালোভাবে চলা ব্যাংক লুটপাট হলো। এমন আরো অনেক দুর্নীতি পুরো ব্যাংকিং খাকে ভয়াবহ অব্যবস্থাপনা, অস্থিরতা ও সংকটে ঠেলে দিয়েছে। আর এতে শঙ্কিত হয়ে ব্যাংকবিমুখ হয়েছে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ।
তবে এ বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পাশাপাশি সামগ্রিক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জন ছিল আরেকটি বড় সুখবর। সব খাত মিলে গত নয় মাসে মোট রপ্তানিতে ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশ থেকে মোট ৩ হাজার ৯০ কোটি ৩০ লাখ ২০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ সময় দেশের শীর্ষ রপ্তানিপণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৫৯৫ কোটি ১৪ লাখ ২০ হাজার ডলারের। এ খাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময় দেশে উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ১২ শতাংশ এবং প্রাথমিক পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
যদিও সংশ্লিষ্টরা এখনো বলছেন, রপ্তানি খাতগুলো এখনো বহুমুখী হয়ে উঠতে পারেনি। মোট রপ্তানির ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশের উৎস এখনো তৈরি পোশাকের। পণ্যটির রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বলেই দেশের সামগ্রিক রপ্তানি খাতে এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
আর বাংলা বছরের শেষ অংশে এসে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির খবর ছিল অন্যতম আলোচনা। যা দেশের সামগ্রিক শিল্প খাতকে নাড়া দিয়েছে। কারণ বিগত দশ বছরে ছয় দফা গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরও গত মাসে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো সব শ্রেণির গ্যাসের দাম গড়ে ১০২ শতাংশ বাড়ানোর দাবি করেছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা ছিল সার ও বিদ্যুৎ খাতে। যদিও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, তারপরও ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
কারণ নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে কারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের চুলার বিল বাবদ খরচ বাড়বে। সবমিলে সব ক্ষেত্রেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির মাশুল দিতে হবে সাধারণ মানুষকে। কারণ ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ব্যয় ওঠাবেন, সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে গ্যাসের বাড়তি দাম ওঠাবে, পরিবহন ব্যবসায়ীরা বাড়াবেন ভাড়া। আর এতে জনসাধারণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। আর সেটা উসকে দেবে মূল্যস্ফীতিকে।